চলতি বছর শুরু হওয়া ডেঙ্গু বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং বছরব্যাপী ডেঙ্গু রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ওঠা-নামা করেছে। কখনও কখনও তা আশঙ্কাজনক পর্যায়েও চলে গেছে। আর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে সরকারি হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি হিসেবের রয়েছে বিপুল পার্থক্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হিসাবকে ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রকৃত রোগী ও প্রকৃত মৃত্যুর আসল চিত্র’ বলে ধরা যাবে না। তারা বলছেন, সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন থেকেই বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা-কর্মকৌশল নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কাজ না করলে আগামী বছর রোগটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, চলতি বছরে গত ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৭ হাজার ৩৯১ জন। হাসপাতাল ছেড়েছেন ৯৬ হাজার ৩৮৮ জন।
চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও রেকর্ড করেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিশ্চিত করতে গঠন করে একটি ডেথ রিভিউ কমিটি। ৭ নভেম্বর কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত আইইডিসিআরে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা ২৫১টি মৃত্যুর ঘটনায় ১৭৯টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে তারা ১১২টি মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। এর আগে ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৯৩টি ২০০০ সালে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি এই হিসাবের চেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত ‘প্রকৃত রোগী এবং প্রকৃত মৃত্যুর আসল চিত্র’ বলে ধরা যাবে না, প্রকৃত রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কন্ট্রোল রুম যে কয়টি হাসপাতালের তথ্য দেয়, তার বাইরে হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গলির ওষুধের দোকানের সংখ্যাও এতে যোগ করা হয় না, হাসপাতালে বহির্বিভাগ থেকে কত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, সেটাও এই তথ্যের ভেতরে নেই। কেবল ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দিয়েছেন তারা। আর বিপুল সংখ্যক রোগী রয়েছেন, যারা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে, হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন, সরকারি হিসেবে যুক্ত হয়নি তারাও, যারা চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাই ঠিক কত মানুষ এবারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি এই হিসাব থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
কন্ট্রোল রুম জানায়, ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২৯৫ জন। এখনও কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ, কতদিন এ অবস্থা থাকবে সেটা বলতে পারছেন না কেউ, যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে। এখন থেকেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, মশক নিধন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ার কোনও সুযোগ নেই। নয়তো আগামী বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
এদিকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কাজ করেছেন আইসিডিডিআর’বির সাবেক গবেষক আতিক আহসান। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রয়োজন। ডেঙ্গু এখন আর এপিডেমিক নয়, এনডেমিক হয়ে গেছে; সারা বছর ধরেই এতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এই বছরে।’
আতিক আহসান আরও বলেন, ‘যেখানে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে, সেখানেই মশা নিধনের ব্যবস্থা নিতে হবে, আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কোথায় বেশি বা কম সেই বিষয়টি সবার আগে জানা প্রয়োজন। কারণ, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা জানা গেলেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এস এম আলমগীর বলেন, ‘‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে যেসব কার্যক্রম চলছিল সে কাজগুলো চলমান রাখতে হবে, কোনোভাবেই এসব কাজ থামিয়ে দিলে চলবে না। একইসঙ্গে মানুষকে ব্যক্তিগতভাবেও সচেতন থাকতে হবে।’
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সব প্রোগ্রাম ‘স্লো’ হয়ে গেছে। কোনও কর্মসূচি এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু ডেঙ্গু বছরব্যাপী চলবে। এখন আর কোনও নির্দিষ্ট মাস বা নির্দিষ্ট সময় নেই, কখনও কখনও কিছুটা হয়তো কমে আসবে।’’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘শীতের সময়ে কমবে। কারণ আউটডোর কন্টেইনার কমে যাবে। বৃষ্টি কম মানে আউটডোরে মশা তৈরির জায়গা কমবে, কিন্তু ইনডোরে যে মশা তৈরির জায়গাগুলো রয়েছে, যেসব জায়গায় মানুষ পানি জমিয়ে রাখে, আন্ডার কনস্ট্রাকশন যেসব কাজগুলো চলছে, সেখানে সবসময়ই পানি জমে থাকে। এজন্য সারাবছর ডেঙ্গু থাকবে। তাই আগামী বছরের জন্য যেসব প্রোগ্রাম বা প্ল্যানিং রয়েছে, সেগুলো সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, সচিব—সবাইকে দেওয়া হয়েছে। এসব পরিকল্পনা যদি কার্যকর করা না হয়, তাহলে আগামী বছরে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
এদিকে, কাজের গতি কিছুটা কমেছে বলে স্বীকার করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, ‘কিছুটা গতি কমেছে এটাও সত্য। তবে, আমাদের কাজকর্মও থামেনি। আগের মতো নিয়মিত কাজগুলো চলমান রয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা পুরনো ওষুধ বাদ দিয়ে নতুন ওষুধ ব্যবহার শুরু করেছি। পাশাপাশি ৫ বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি।’ এজন্য একটি বিশেষ প্রকল্প নিতে মন্ত্রণালয়ের আনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান।
উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মশা নিধনে আমরা এরই মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করেছি। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১১টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে। সেখানে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আগামীকাল বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে একটি বৈঠক করবো। আমাদের কার্যক্রম কীভাবে আরও জোরদার করা যায়, সে দিকে এখন নজর দিচ্ছি। এ জন্য আমরা একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’
আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা চাই এ কাজে সবাই অন্তর্ভুক্ত হোক। আর মশার জন্মস্থান যদি আমাদের হয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। যদি অন্য সংস্থার হয় তাহলে আমরা তাদের ডেকে বলবো, তারা যেন সেখানের ব্যবস্থা নেয়।’ রাজধানীর খালগুলো পরিষ্কার রাখার জন্যও ওয়াসার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। – বাংলা ট্রিবিউন