ভিসিই দলীয় ছাত্রদের প্রশ্রয়দাতা

মো. জয়নুল আবেদীন, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক; চার মেয়াদে বুয়েট শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

: বুয়েটে সনি হত্যার পর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেটা কার্যকর হয়নি, আবরার হত্যার পর তা কেন টিকবে?

জয়নুল আবেদীন: ছাত্ররাজনীতি নয়, আসলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা না পেলে তা স্থায়ীভাবে কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে আমি মনে করি, ছাত্রদের কল্যাণ ও অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে অনুসৃত সর্বোত্তম নীতিমালার প্রয়োগই ছাত্ররাজনীতি। এ বিষয়ে বুয়েট আইনে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইউকসু) ও হল ছাত্র সংসদের যে নীতিমালা আছে, তা অনুসরণ করলেই চলে। বুয়েট আইনে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদগুলোর সহসভাপতি ও সম্পাদকদের দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি নির্ধারিত আছে। এই সংসদগুলোকে ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে সভা করতে হবে। ছাত্রদের মানবিক গুণাবলি বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষাসহায়ক বিভিন্ন কার্যক্রম চালাতে হবে। ভবিষ্যতে যাঁরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেবেন, তাঁদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজনীয়। ছাত্রদের সাংগঠনিক রাজনীতিতে এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কি না, আমার জানা নেই। কাজেই দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন নিয়মিতকরণ। ছাত্র সংসদগুলো অচল থাকার কারণে এটাকে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলা হয়েছে।

: আপনি সনি হত্যার সময় ছাত্রকল্যাণ পরিচালক বা ডিএসডব্লিউ ছিলেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এর মিল–অমিল কী?

জয়নুল আবেদীন: সনির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু টেন্ডার–সন্ত্রাসের নির্মম পরিণতি; বুয়েটের তৎকালীন সরকারদলীয় কিছু সন্ত্রাসী ছাত্র ও বাইরের সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছুদিন আগেই বুয়েটের উপাচার্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে একাধিক চিঠি দিয়েছিলেন। লালবাগ থানাকেও সম্ভাব্য টেন্ডার–সন্ত্রাস সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন কোনো প্রতিকার মেলেনি। সনি হত্যার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের তেমন কোনো গাফিলতি খুঁজে পেয়েছে বলে মনে হয়নি। আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট আলাদা। আপাতদৃষ্টিতে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কিছুসংখ্যক সন্ত্রাসী ছাত্র এ জন্য দায়ী। এটা পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড, যা শেরেবাংলা হলের কথিত টর্চার সেলে ঘটেছে। কিন্তু হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। কাজেই এর দায়দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। উপাচার্যের নিষ্ক্রিয়তা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনকে অকার্যকর করে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় একজন উপাচার্যের যে নৈতিক দৃঢ়তা থাকা দরকার, তা তাঁর নেই। তিনি রাজনৈতিক আনুগত্য দেখিয়ে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, দলীয় ছাত্রদেরও সেভাবে প্রশ্রয় দেন। বুয়েটের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার জন্য এই বাস্তবতা অনেকাংশে দায়ী।

: কখন থেকে বিপর্যয়ের শুরু? আপনি তো ২০১৭ সাল পর্যন্ত বুয়েটে ছিলেন।

জয়নুল আবেদীন: সরকারদলীয় ছাত্রদের আধিপত্য বিস্তারের শুরু ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে। ২০০৯ সালে বুয়েটে প্রথমবারের মতো প্রোভিসি নিয়োগ ও ২০১০ সালে অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে ভিসি নিয়োগের পর থেকেই দলীয় ছাত্রদের আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে পরোক্ষভাবে দলীয় শিক্ষক, দলীয় কর্মকর্তা ও দলীয় কর্মচারীদের আধিপত্য বিস্তারের সূচনা হয়। বর্তমান উপাচার্য নিয়োগের পর আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি চরম আকার ধারণ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে হলে কিছু অনিয়ম হয়েছে এবং পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন হয়েছে। কিছু ছাত্র পাস করার পরও লুকিয়ে–ছাপিয়ে কিছুদিন অবৈধভাবে হলে থাকত। এ রকম অনিয়ম সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু টর্চার সেলের কথা কখনো শুনিনি। র‍্যাগিং নিয়ে কিছু কথা বলার আছে। র‍্যাগিংয়ের শুরু মূলত স্থাপত্য বিভাগ থেকে, অন্যান্য বিভাগ বা হলে র‍্যাগিং ছিল না। আমি যখন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, তখন কয়েকজন অভিভাবক গোপনে আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আমরা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। অভিভাবকেরাও আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে চাননি। তখন অভিভাবকদের ভয় ছিল যে অভিযোগ করার পর যদি কার্যকর প্রতিকার না পাওয়া যায়, তাহলে তাঁরা বরং উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারপর থেকে স্থাপত্য বিভাগের র‍্যাগিং বন্ধ ছিল।

: আমরা এখন সেক্সুয়াল র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ শুনছি।

জয়নুল আবেদীন: আমি ছাত্রকল্যাণ পরিচালক থাকার সময় এ রকম অভিযোগ আসেনি। এখন এ ধরনের র‍্যাগিং হয়, এ কথা আমার কানেও এসেছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া।

: ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিতর্কে না জড়িয়ে বুয়েট তার চত্বরে বেআইনি সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধের আইনটি কার্যকর করা সম্ভব কি না?

জয়নুল আবেদীন: আইন বলছে, ডিএসডব্লিউর অনুমতি ছাড়া কোনো ছাত্র কোনো সংগঠন করতে পারবেন না। কিন্তু করলে কী হবে, তা নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। আমি মনে করি, বিদ্যমান আইন সংশোধন করা দরকার। একাডেমিক কাউন্সিলকে উদ্যোগ নিতে হবে। আর সরকারকে বোঝাতে হবে যে এটা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং তার আইন স্বতন্ত্র। স্বাধীনতার পর ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ চালু হলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুয়েট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই অধ্যাদেশ চালু করতে সম্মত হননি। তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তিনি যথোপযুক্ত আইন চালু করবেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ফলে তা আর ফলপ্রসূ হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু সুচিন্তিতভাবে বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের আওতায় নেননি।

: বুয়েটের পাশে ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্রসংগঠন যেভাবে চলে আসছে, সেটা থেকে বুয়েটের একটা স্বাতন্ত্র্য বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন?

জয়নুল আবেদীন: আমি তা–ই মনে করি। একটি প্রকৌশল ও কারিগরি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েটকে তিনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে বুয়েট সিদ্ধান্ত নিক, আমি মনে করি সেটা বঙ্গবন্ধুর সেই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

: কোনো ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরলেই বলা হয়, ক্ষমতাসীন দলকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। ধরুন, সেটা হবে না। কিন্তু বুয়েট তার কাজটা করুক। আইনটা কার্যকর করুক। সেটা কি হবে?

জয়নুল আবেদীন: উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে হয় তিনি বুয়েটকে ধারণ করেন না। তিনি এটাকে চাকরি হিসেবে নিয়েছেন। যে পদক্ষেপ নিলে এ মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, তিনি তা–ই করছেন মাত্র। তবে যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বুয়েট সাময়িকভাবে এই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সুফল চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে। শিক্ষকদের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হবে। ভিসি তাঁর আজ্ঞাবহ লোকদের প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটি প্রধানের পদে বসাচ্ছেন। এর রাশ টানতে হবে। আমি স্মরণ করতে পারি না যে বুয়েটের ইতিহাসে উপাচার্য কাউকে কোনো অফিসে নিয়োগদানের পরে ছাত্রদের চাপে সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। এটা অবিশ্বাস্য।

: বুয়েটে সাসপেন্ডেড শাস্তি বিধান কী করে চালু হলো? এটা তো আইনে নেই।

জয়নুল আবেদীন: এটা একটা দীর্ঘকালীন বুয়েট কালচার। এটা আমার সময়েও ছিল। এটা আইনে লেখা নেই। ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে সঠিক পথে রাখার চিন্তা থেকে আমরা এটা অনুসরণ করেছি। অবশ্য আজ যে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ঘটছে, সেটা তো আগে ছিল না।

: এত কাণ্ডের পর কি উপাচার্যের পদত্যাগ করা উচিত নয়? তাঁর মেয়াদ আছে আর ছয় মাস, এর পরের উপাচার্য নিয়োগ কী প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত?

জয়নুল আবেদীন: দেখুন, কে ভালো উপাচার্য হবেন, তা বলা সহজ নয়। বর্তমান ভিসির আগে খালেদা একরামকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভিসি করা হয়েছিল। আমি তখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁকে স্বাগত জানাব না। তাঁকে বলেছিলাম, আপনার নিয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ তিনি ভিসি হয়ে সবার আস্থা অর্জন করলেন। তিনি ভালো প্রশাসক হলেন। সবার মন জয় করলেন। আর বর্তমান ভিসি নিয়োগের সময় সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। আমরা তাঁকে স্বাগত জানালাম। কিন্তু তিনি এমন শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন যে, আমরা স্তম্ভিত হলাম। আমি একটা ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত আশা করি। এটা বাইরে থেকে হওয়া উচিত। বুয়েটের ভিসিদের ঐতিহ্য হলো, তাঁরা সকালবেলাতেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনে বের হবেন। কিন্তু বর্তমান ভিসি ক্যাম্পাসেই থাকেন না। ভিসির নিয়োগের শর্ত হলো তিনি ক্যাম্পাসে থাকবেন।

: অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলছেন ভিসি বুয়েট বিক্রি করার ক্ষমতা রাখেন। বোর্ড অব রেসিডেন্সের ৫ জনে যেহেতু কোরাম হয়, ভিসিকে বাদ দিয়েও শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। অননুমোদিত সংগঠনে যাঁরা বিভিন্ন পদে আছেন, তাঁদের শোকজ করতে শিক্ষকদের যে ক্ষমতা, তার প্রয়োগ চান কি না?

জয়নুল আবেদীন: ভিসির ক্ষমতা অনেক, এ কথা সত্য। বিক্রির কথাটা নিশাত স্যার হয়তো রসিকতার ছলেই বলেছেন। ভিসির সহযোগিতা ছাড়া শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। আইনে শিক্ষকদের ক্ষমতা দেওয়া হলেও ডিসিপ্লিনারি কমিটিকে তা অবহিত করতে হয়, ওই কমিটির সভাপতি উপাচার্য। দীর্ঘদিন ধরে এই আইন কার্যকর করা হয়নি, তাই প্রথমে তাঁদের একটা সতর্কপত্র দেওয়া যেতে পারে। এখনই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এখনই বলে দেওয়া যায় যে, আমরা অনুমোদিত সংগঠনের বাইরে কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিভিন্ন পদধারীদের ক্যাম্পাসে তৎপরতা চালাতে দেব না। ডেডলাইনের পরে যাঁরা লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

: এই সামর্থ্য কি বুয়েটের আছে?

জয়নুল আবেদীন: আছে। বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনকে এ জন্য লেগে থাকতে হবে। তারা নিরপেক্ষ ও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই বাস্তবতা অনুধাবন করবে। দিন শেষে কোনো রাজনৈতিক দলই রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের দায় নেয় না। শিক্ষকদের নৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে সঠিক দায়িত্বটি পালন করতে হবে। তাঁদের ভাবতে হবে যে বুয়েট একটি অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে দেশের মেধাবী ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার্থে আসে; তারা আমাদেরই সন্তান। বুয়েটের প্রতি দেশের মানুষ এখনো আস্থাশীল। আমরা কিছুটা নষ্ট হয়েছি বটে, কিন্তু এখনো পচে যাইনি। – প্রথম আলো