দিন দিন ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলার জট বেড়েই চলেছে। সারাদেশের ৪১টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ মামলা ঝুলছে। এমন ট্রাইব্যুনালও আছে, যেখানে ৪০ হাজারের ওপরে মামলা বিচারাধীন। আবার ট্রাইব্যুনাল থাকলেও এ আইনের বিধান অনুযায়ী আজও গঠন করা হয়নি কোনো আপিল ট্রাইব্যুনাল। এর ফলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। শুধু বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইন সংশোধন করে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে। আর এসব ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা বিচারের এখতিয়ার দেওয়া হবে সারাদেশের দেওয়ানি আদালতগুলোকে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা ভূমি জরিপের মামলা বিচারের অধিক্ষেত্র বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করছি। যেখানে একটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে অনেক আদালতকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। অধিক্ষেত্র বাড়লে জনদুর্ভোগ কমে আসবে।’ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তে এখন ভূমি জরিপের মামলা সহকারী জজ আদালত থেকে যুগ্ম জেলা জজ আদালত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট-১৯৫১ সংশোধনের একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ আইনে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল সংক্রান্ত চ্যাপ্টার (ঢঠওওঅ) বাতিল করা হচ্ছে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে , এই চ্যাপ্টার বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও, এই চ্যাপ্টারের অধীনে (ক) ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত মামলা এই আইনের অধীন দেওয়ানি আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন কোনো মামলা দেওয়ানি আাদালতে এমনভাবে স্থানান্তরিত এবং বিচার্য হবে, যেন তা এই আইন অনুযায়ী দাখিল করা হয়েছে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে এই আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত মামলার রায়, ডিগ্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে এই আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে। আইন সংশোধনের খসড়াটি জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে পাস হতে পারে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ২০০৪ সালে স্টেট একুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট-১৯৫১ সংশোধন করে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও ভূমি জরিপ আপিল ট্র্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান সংযোজন করা হয়। আইন অনুযায়ী ভূমি জরিপ রেকর্ডে ভুলত্রুটি হলে জমির মালিক প্রতিকার পেতে এই ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। ভূমি জরিপের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এক বছর পর্যন্ত সময়ে এই মামলা করা যায়। উপযুক্ত কারণ দর্শানো সাপেক্ষে অতিরিক্ত আরও এক বছর সময় নিতে পারেন জমির মালিকরা।
ভূমি জরিপের ভুলত্রুটির ব্যাপারে প্রতিকার পেতে ২০০৪ সালে আইন সংশোধন করে ১২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ায়। এখন ট্রাইব্যুনাল ৪১টি। গত ৩০ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী এসব ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭০২টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫৬ হাজার ১৪৫টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ১৬৮টি। ৪১টি ট্রাইব্যুনালের মধ্যে কিশোরগঞ্জের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা ৪৩ হাজার ১৭৮টি। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালগুলোতে এখন একজন যুগ্ম জেলা জজ বিচারকাজ পরিচালনা করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় নির্দিষ্ট বিচারক ছাড়া অন্য কেউ মামলা পরিচালনা করতে পারেন না। তাই বিপুলসংখ্যক মামলা একটি ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন থাকায় এক একটি মামলা শুনানির তারিখ ধার্য করতে হচ্ছে ছয় মাস থেকে এক বছর পরপর। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে; বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়ছে। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনেও ট্রাইব্যুনালের দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০০৪ সালে আইন সংশোধন করে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আপিল ট্রাইব্যুনাল নেই। ফলে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় আপিল করতে পারত না। সংক্ষুব্ধ পক্ষকে সরাসরি হাইকোর্টে রিট করে প্রতিকার চাইতে হয়। এ বিষয়টি লক্ষ করে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করে আপিল ট্রাইব্যুনাল কেন গঠন করা হয়নি তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। ফলে একদিকে ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলার জট, অন্যদিকে আপিল করার সুযোগ না থাকায় এ আইনের অধীনে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না।
জানা যায়, মামলাজট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে ২০১৭ সালে আইন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা আগের মতো সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজদের বিচারিক আদালতে এই মামলা পরিচালনার এখতিয়ার দিয়ে বিধান সংশোধনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিল। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট জেলা জজকেও আপিল আদালত হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ ছিল। প্রায় দেড় বছর পর চলতি বছরের ফেব্রুারিতে ভূমি মন্ত্রণালয় বিধানটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে। আইন মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও সংশোধনীর বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য গত মাসে একটি উপকমিটি গঠন করেছে।
কমিটির সভাপতি সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু এমপি বলেন, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মানুষের হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে। গ্রামের সাধারণ ভূমিমালিকরাই এর ভুক্তভোগী। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবেও বিব্রতবোধ করি তাদের হয়রানির কথা শুনে। তাই আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।