প্রযুক্তি ও চুক্তির সীমাবদ্ধতায় গতি নেই সাগরের তেল গ্যাস উত্তোলনে

বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের বিরোধ ছিল। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর নিষ্পত্তি হয় এসব সমস্যার। কথা ছিল, সমুদ্রসীমা বুঝে পেলে সমুদ্রসম্পদ আহরণে নেয়া হবে নানা উদ্যোগ। এজন্য পরিকল্পনারও অন্ত ছিল না। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে নয় বছর আগে, আর ভারতের সঙ্গে বিরোধ মিটেছে তারও সাত বছর পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে নিজেদের সাগর থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে অনেক এগিয়ে গেছে দেশ দুটি। কেবল পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই আটকে রয়েছে।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন দীর্ঘ সময় পরেও গভীর-অগভীর সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে যথেষ্ট অগ্রগতি নেই তা জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তাদের করা এক প্রতিবেদনে তিন ধরনের সীমাবদ্ধতার কথা উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে ভূতাত্ত্বিক, অনুসন্ধান ব্যয়, ঝুঁকি, প্রযুক্তি ও উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আর্থিক শর্তাবলির বিভিন্ন বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর মাঝে স্ট্রাকচারাল ও স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্লে টাইপের মিশ্রণ লক্ষণীয়। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র ও এর সংলগ্ন ব্লক এসএস-৪, এসএস-৯-এ স্ট্রাকচারাল ট্র্যাপ রয়েছে। তবে একটু গভীরে এস-১১ ব্লকে স্ট্রাকচারাল ও স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্লে দেখা যায়, যা দক্ষিণে ক্রমেই স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্লে বা ফ্যান ডিপোজিটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সিসমিক ডাটা পর্যালোচনায় গভীর সমুদ্র ব্লক ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্লে বলে শনাক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্বাংশের গভীর সমুদ্র ব্লকগুলোর প্লে টাইপ স্ট্র্যাটিগ্রাফিক। গভীর সমুদ্র ব্লকগুলোয় স্ট্র্যাটিগ্রাফিক প্লে (ফ্যান ডিপোজিট) চিহ্নিত হওয়ায় এগুলোর সিল নিয়ে ঝুঁকি অনেক বেশি।

আবার সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয় ও ঝুঁকি স্থলভাগের চেয়ে অনেক বেশি। তুলনামূলক কম খরচে সিসমিক সার্ভে করা গেলেও অনুসন্ধান, কূপ খনন, উন্নয়ন কূপ খনন, উৎপাদন সুবিধার উন্নয়ন, পাইপলাইন নির্মাণের মতো কাজগুলো যথেষ্ট প্রযুক্তিনির্ভর ও ব্যয়বহুল। এছাড়া অনুসন্ধান থেকে শুরু করে কূপ খনন পর্যন্ত প্রতিটি কাজ উচ্চঝুঁকির। প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, এসব ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীরা ফিরেও যেতে পারে।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) স্থলভাগে অনুসন্ধানের জন্য সক্ষম। কিন্তু সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যে ধরনের কারিগরি, আর্থিক ও জনবলের প্রয়োজন সেটি সংস্থাটির নেই। তবে অগভীর সমুদ্র ব্লকে বাপেক্সের জন্য ১০ শতাংশ ক্যারিড ইন্টারেস্টের বিধান রাখা আছে। প্রযুক্তি, ব্যয় ও ঝুঁকি বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ চুক্তির আর্থিক শর্তাবলি-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, এ-যাবৎ স্বাক্ষরিত পিএসসির আওতায় আহরিত তথ্য বিশ্লেষণে কয়েকটি ব্লক সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। কিন্তু পিএসসিতে যে আর্থিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল তা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাজে তাদের পরবর্তী বিনিয়োগের জন্য অনুকূল মনে না হওয়ায় তারা ব্লকগুলো ছেড়ে দেয়। বিশেষ করে প্রতি ক্ষেত্রেই তারা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য অনুরোধ জানায়।

মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভের জন্য টিজিএস-স্কামবার্জার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর তারা ডাটা বিক্রির বিষয়টি প্রচারের জন্য পৃথিবীর বড় বড় তেল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রায় প্রতিটি কোম্পানি জানায়, চলমান বৈশ্বিক কভিড-১৯ মহামারীর কারণে তারা ব্যয় সংকোচন করেছে। এ পরিস্থিতিতে তারা নতুন বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের অফশোর মডেল পিএসসি ২০১৯-এর আর্থিক শর্তগুলো আরো উন্নত করতে অনুরোধ জানায়। বেশির ভাগ কোম্পানি গ্যাসের দাম ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার মাত্রা আরো বাড়ানোর বিষয়ে মতামত দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে বেশকিছু পরিকল্পনার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো অফশোর মডেল পিএসসিকে পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান জানান, প্রতিবেদনটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। দেশে জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে আরো উদ্যোগী হতে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম বলেন, ভূতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার কথা যেটি বলা হচ্ছে সেটি ঠিক নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ সমুদ্র থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উত্তোলন করতে পারছে। তাহলে বাংলাদেশেরও তা পারার কথা। বাংলাদেশের সমুদ্রের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আর ভারতের সমুদ্রের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলাদা হওয়ার কথা নয়। এজন্য যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন।

১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি সমুদ্রবক্ষে দেশের প্রথম গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু আবিষ্কার করে। ১৯৯৮ সালে গ্যাসক্ষেত্রটিতে উৎপাদন শুরু হয়। গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি থেকে উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় ৫০০ বিসিএফ গ্যাস উৎপাদন হয়েছে।

২০০৮ সালের অফশোর বিডিং রাউন্ডের আওতায় ২০১১ সালের জুনে গভীর সমুদ্রের দুটি ব্লক ডিএস-১০ ও ডিএস-১১-এর জন্য কনোকোফিলিপসের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) মোতাবেক ৫ হাজার ৮৬০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক সিসমিক জরিপ সম্পন্ন হয়। স্বাক্ষরিত পিএসসির আর্থিক শর্তাবলি তাদের অনুকূলে না হওয়ায় ২০১৪ সালে কনোকোফিলিপস ব্লক দুটি ছেড়ে দেয়।

২০১২ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের পর ওই বছর দরপত্র আহ্বান হয়। এর আওতায় ২০১৪ সালে তিনটি অগভীর সমুদ্রের ব্লকের জন্য তিনটি অগভীর সমুদ্রের ব্লকের জন্য তিনটি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ৮ হাজার ৭২০ লাইন কিলোমিটার টুডি ও ৩০৫ বর্গকিলোমিটার থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হয়। গত বছর খনন না করেই স্যান্টোস ব্লকটি ছেড়ে দেয়। ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড গত ২৯ সেপ্টেম্বর ব্লক এসএস-৪-এ আরো একটি অনুসন্ধান কূপ খনন শুরু করেছে। আগামী বছর আরো দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

এরপর ২০১৭ সালের বিশেষ বিধানের আওতায় গভীর সমুদ্রের ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে বছরই ব্লক ডিএস-১২-এর জন্য পসকোর সঙ্গে পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। পসকো ডাইয়ু এ ব্লকে ৩ হাজার ৫৮০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক সিসমিক জরিপ ও ইন্টারপ্রিটেশনের কাজ সম্পন্ন করে। পরে পিএসসির আর্থিক শর্ত নিজেদের অনুকূলে না যাওয়ায় তারাও ব্লকটি ছেড়ে দেয়।