জাতীয় নিরাপত্তায় অনাহূত নিঃশ্বাস!

মাসুম খলিলী:

বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যে দেশে ভ্রমণ করা যায় না, সেই দেশটির নাম ইসরাইল। কিন্তু দেশটি মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাতে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে, ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে ইসরাইল স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের স্বীকৃতি প্রদানকে তখন প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ একটি চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, এই স্বীকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের কোনো সরকারই ইসরাইলের সাথে দৃশ্যমান সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেনি। ফলে দেশটির সাথে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি বাংলাদেশের।

আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে অনেক কিছুই এখন আগের মতো নেই। মিসর, জর্দান, তুরস্কের মতো কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ঘোষিত কূটনৈতিক সম্পর্ক ইসরাইলের তৈরি না হলেও ভেতরে ভেতরে সেই অবস্থা অনেকখানি পাল্টে গেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন না করেই শীর্ষস্থানীয় আরব দেশগুলো ইসরাইলের সাথে গোয়েন্দা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন কি আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এক ধরনের কৌশলগত নির্ভরতার সম্পর্কও ইসরাইলের সাথে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আরব দেশের।

এই অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশটির নাম হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ ক্ষুদ্র দেশটি ইসরাইলের সাথে অঘোষিত কৌশলগত সম্পর্কের কারণে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এক প্রভাবক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর পাশাপাশি, সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের গোয়েন্দাযোগাযোগ মুসলিম দেশগুলোর সাথে দেশটির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে কাজ করছে। সৌদি আরবের সাথে এই সম্পর্কটি মূলত অনেক দূর এগিয়ে গেছে দেশটির সামনে ইরান অনেক বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয়ার পর।

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে নানাভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ইসরাইলের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর অঘোষিত সম্পর্কের মোড় পরিবর্তনের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষত ভারতের সাথে ইসরাইলি সম্পর্কও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারতের দৃশ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ছিল ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলোর। কিন্তু ভারতের নেতৃত্ব সব সময় অঘোষিতভাবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। সেই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক রূপ নেয় ১৯৯২ সালে। এরপর গত তিন দশকে এই সম্পর্ক কেবলই সামনে এগিয়েছে। আর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্ক অর্থনীতি ও বাণিজ্য পেরিয়ে কৌশলগত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের পর্যায়ে উন্নীত হয়। দুই দেশেরই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ সময় নিয়ে পরস্পরের দেশ সফর করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।

উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভারতের সাথে ইসরাইলের সম্পর্কের এই ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশ নিয়ে তেলআবিবের আগ্রহ বেশ বাড়িয়ে তোলে। ষাটের দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরবদের পক্ষে পাকিস্তানের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশটির প্রতি ইসরাইলের বিশেষ বৈরিতা সৃষ্টি করেছে। এই সাধারণ বৈরিতা ইসরাইলের ভারত ঘনিষ্ঠতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। এই রসায়নটি বিশেষভাবে এগিয়ে যায় ভারতের কাশ্মিরের বিদ্রোহ দমনে পারস্পরিক সহায়তার ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরে দমন কৌশলের অসাধারণ মিল নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একটি লেখা লিখেছেন।

তাৎপর্যের বিষয় হলো, কাশ্মিরে স্বায়ত্তশাসনসহ বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করার সাম্প্রতিক উদ্যোগ নেয়ার পর ভারতের এই অবস্থানের ব্যাপারে প্রথম প্রকাশ্য সমর্থন জ্ঞাপন করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। মনে করা হয়, রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তার গ্যারান্টিপ্রাপ্তির বিনিময়ে মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামের আদর্শিক আবেদন বিলুপ্ত করা তথা রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমিরাতকে।

বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান সমর্থন করে। তবে দৈনিক জেরুসালেম পোস্টে প্রকাশিত ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের এক বিবৃতিতে ইসরাইল সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা সংলাপ চাই। আমরা জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক চাই। আমরা বাংলাদেশের ধর্মীয় মনের মানুষদের সফরকে (পড়–ন ‘কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা’) স্বাগত জানাই জেরুসালেমের পবিত্র ভূমিতে।’

১৯৯২ সালে চীন ও ভারতের সাথে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পরে ইসরাইল বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক চাইছে বলে উল্লেখ করা হয় ইসরাইলি গণমাধ্যমে। এর পরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছি এবং ইসরাইলিদের তাদের জমি দখল কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়, বাংলাদেশ ক্রমেই দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতার এক নতুন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। এ অঞ্চলকে অস্থির করার খেলা শুরু হয়েছে বেশ ক’বছর আগে থেকেই। ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে সামরিক সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় এ দেশে। এই সরকারের নানা ধরনের বিতর্কিত পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ধারাবাহিক স্থিতিকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেয়। এ সময় দুর্নীতিবাজ ধরার নামে দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তাদের এমনভাবে হয়রানি করা হয় যে, এর পরে বিনিয়োগ স্থবিরতার অবসান আর ঘটেনি। অনেক শিল্পোদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের জন্য চীন, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য স্থিতিশীল দেশ বেছে নেয়। তত্ত্বাবধায়ক-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেছে।

সাধারণভাবে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের পর যে ধরনের বৈপ্লবিক বা প্রতিশোধপরায়ণতা বিশ্বের কোনো কোনো দেশে দেখা গেছে, তার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায় এর পরের বছরগুলোতে। এ সময় যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বা কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে কতটা সক্রিয় আর কতটা বাইরের অ্যাজেন্ডা পালনে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। অনেকের বক্তব্য, গত এক দশকে সরকারের সব কার্যক্রম নিজের ইচ্ছায় হয়নি। কিছু অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের শর্ত মেনে তাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল। আর পরে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাকে ঠিক করে দেয়া অ্যাজেন্ডা কার্যকর করতে হচ্ছে। এর বাইরে যাওয়া এ সরকারের জন্য সম্ভব হবে না। কারণ গেলে তখন সরকার আর হয়তো ক্ষমতায় থাকবে না।

বাংলাদেশের ঘটনাপরম্পরাকে যারা গভীর থেকে বিশ্লেষণ করেন, তাদের সামনে বিশেষ কিছু বিষয় চলে আসে। বাংলাদেশে প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি ও বিশ্বশক্তিগুলো এ দেশে সামাজিকভাবে বিভাজন প্রত্যাশা করেছে নিজ নিজ স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে। এ বিভাজন রাষ্ট্রের মধ্যে এক দিকে পারস্পরিক বৈরিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে, অন্য দিকে শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ করবে। কার্যত ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ বিভাজন রাষ্ট্রকে স্পষ্ট দু’টি শিবিরে বিভক্ত করেছে এবং এর মাধ্যমে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেশের রাজনৈতিক শক্তি কোনো বড় রকমের জাতীয় ইস্যুতেও এক হতে না পারে।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এর পেছনে একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিমান ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা সক্রিয় ছিল। এই দুই রাষ্ট্রের কাজ অভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। প্রতিবেশী দেশটি মনে করেছে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী ইসলামিস্ট ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করা গেলে এ দেশের রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটির লক্ষ্য অনেক গভীরে। তাদের লক্ষ্য হলো, এ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা। এ জন্য এ অঞ্চলের তিন দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতি তাদের দৃষ্টি অনেক দিনের।

শত শত বছর ধরে এখানকার উপজাতীয় অঞ্চলগুলোতে ধর্মান্তরের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে। খ্রিষ্টান মিশনারি তৎপরতায় ভারতের সাত রাজ্যের বেশির ভাগে অহিন্দুরা সম্মিলিতভাবে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কয়েকটি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে খ্রিষ্টানরা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের শিন রাজ্যেও একই ধরনের মিশনারি তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের মিজোরাম ও মনিপুরে কয়েকটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবিষ্কার করা হয় ‘ইহুদিদের হারানো গোত্রের মধ্যে একটি গোত্র’। তাদেরকে বলা হচ্ছে যুশেফের (হজরত ইউসুফ আ:) সন্তান মেনাসের বংশধর। তাদের আচার-আচরণ, জীবনাচরণ ও ধর্মচর্চায় প্রভাব আবিষ্কার করা হয়েছে জুডাইজমের। হারানো ইহুদি গোত্রের অন্য কয়েকটি ভারতের অন্য অঞ্চলে বাস করে বলে উল্লেখ করা হয়।

গত দশকে ইসরাইলের শীর্ষ স্থানীয় ইহুদি রাব্বি (যাজক) শ্লোমো আমরের রুলিংয়ের ওপর ভিত্তি করে মনিপুর-মিজোরামের ৯ হাজার লোককে ইহুদি হিসেবে ইসরাইলে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। রাব্বি শ্লোমো হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্রের বংশধর হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দিলেও শত শত বছর ধরে ইহুদি ধর্মাচার থেকে দূরে থাকার কারণে তাদের ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেন। এভাবে নানা টানাপড়েনের মধ্যেও মনিপুর-মিজোরাম থেকে কথিত ইহুদিরা ইসরাইলে পুনর্বাসিত হয়েছে এবং তাদের বিতর্কিত ফিলিস্তিন অঞ্চলগুলোতে বসতির ব্যবস্থা করা হয়।

এর মধ্যে ইহুদি রাব্বিরা ইসরাইলে ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে এসেও মনিপুর-মিজোরোমের কুকি, মিজো ও শিনদের ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর কাজ করেন। এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর এই কাজ নেপালে নিয়ে গিয়ে সম্পন্ন করা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কথিত হারানো গোত্রের ইহুদিদের ইসরাইলে নিয়ে যাওয়াতে বড় রকমের বিপত্তি না ঘটলেও ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানদের ইহুদি ধর্মমতে ফিরিয়ে আনা আর তাদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবি ওঠানোর পর ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মিজোরামে ইহুদিদের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কা চেপে বসে।

মিজোরামের রাজধানী আইজলস্থ খ্রিষ্টান গবেষণা কেন্দ্রের ড. বিয়াকশিয়ামা বলেন, ‘বিদেশী রাব্বি এসে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মান্তরে এই এলাকায় শুধু সামাজিক অস্থিরতাই সৃষ্টি হচ্ছে না। একই সাথে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষ অন্য দেশের নাগরিকত্ব লাভের উপযুক্ত হচ্ছে, যাতে ভারতের প্রতি তাদের আনুগত্য হয়ে পড়ছে প্রশ্নসাপেক্ষ।’

এটি আরো বেশি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় যখন ড. বিয়াকশিয়ামা ২০০৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শিঙল্যাং ইসরাইল পিপলস কনভেনশনের (সিআইপিসি) প্রতিষ্ঠাতা লালশানিমা সাইলোর একটি বক্তব্য তুলে ধরেন। এই বক্তব্যে সাইলো বলেছেন, ‘সিআইপিসির লক্ষ্য এখানকার ইহুদিদের ইসরাইলে পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো নয়, জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে এই এলাকাকে মিজো উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা করা, যা সেখানে মিজো ইসরাইলিদের একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করবে।’ এর পর থেকে মিজোরাম বা মনিপুর থেকে ইসরাইলে পুনর্বাসন অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু ইহুদি ধর্মমতে পাহাড়িদের প্রত্যাবাসন চলছে অব্যাহতভাবে।

১৯৫১ সালে একজন পাহাড়ি নেতা ইসরাইলে গিয়ে ইহুদি ধর্ম বা জুদাইজমে দীক্ষা নেন এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে মিজোদের ইহুদি সম্পৃক্ততার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান। এর পর থেকে মিজোরাম-মনিপুরে কথিত ইহুদি ধর্মমতে প্রত্যাবাসন বাড়তে থাকে। ফলে বর্তমানে মিজোরামে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ আর খ্রিষ্টানদের সংখ্যা অনেক কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর আগে খ্রিষ্টধর্মমত গ্রহণকারী মিজো, কুকি, শিনরা প্রধানত ইহুদি ধর্মমতে চলে আসায় ইহুদি সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমে যায় খ্রিষ্টান সংখ্যা। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অচিরেই রাজ্যটিতে ইহুদি সংখ্যা খ্রিষ্টানদের ছাড়িয়ে যাবে।

মিজোরামে ‘শিঙল্যাং ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গোপন সমঝোতার কথা জানা যায়। সে অনুসারে মিজোরামে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সহযোগিতার বিনিময়ে ইহুদিরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। শিন-কুকি-মিজো উপজাতীয়দের যাদেরকে ইহুদিদের হারানো গোত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তাদের বসবাস মিজোরাম মনিপুরের বাইরে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের শিন রাজ্যেও রয়েছে।

এ ব্যাপারে ইহুদিদের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে শিন-কুকি-মিজো এবং অন্য পাহাড়িদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ রয়েছে; যারা ‘এক সময়ের হারানো’ ইহুদি গোত্রের বংশধর। এই জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত মনে করা হচ্ছে। ইসরাইলে যে এক লাখের কাছাকাছি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি রয়েছে, এ লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করা গেলে তাদের প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনা হতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মিজোরাম বা মনিপুরে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের শিন-রাখাইন রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির কী সম্পর্ক থাকতে পারে? বিশ্বরাজনীতির নিয়ম অনুসারে, কোনো অঞ্চলে নতুন কোনো বিন্যাস ঘটাতে হলে সেখানে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে হয়। গত এক যুগে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে। এ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর সামনে সম্ভাব্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইসলামিস্টরা। এই কাজ বিএনপিকে দিয়ে করানো সম্ভব হবে না বিধায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে বিএনপির কোমর ভাঙা হয় প্রথমে।

এরপর এমন এক সাজানো নির্বাচন করা হয় যাতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে ‘মহাজোটের সরকার’। সে সরকারকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, নির্যাতন ও দমনের মাধ্যমে দেশে চরম সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর পর ২০১৪ সালে একটি একতরফা সংসদ নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হয় শাসকদেরকে। সর্বশেষ, গত ডিসেম্বরে আয়োজন করা হয় এমন আরেকটি নির্বাচনের, যেটি ‘মধ্যরাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ক্ষমতাসীনদের যে অ্যাজেন্ডা দেয়া হয়েছে, সে কার্যক্রম শেষ হলে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারকে আর ক্ষমতায় রাখার দরকার নাও থাকতে পারে। নেপথ্যে থেকে একটি শক্তি একটি আল্ট্রা সেকুলার ফোর্সকে দিয়ে ইসলামিস্টদের দমনের চেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান। সেই শক্তি এক সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় একতরফা ‘ভারতবান্ধব’ সরকারকে ক্ষমতায় আর না-ও চাইতে পারে। সেটি হতে পারে পটপরিবর্তনের একটি কারণও।

গত এক দশকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী শক্তি এক হয়ে কাজ করেছে। সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো দেখে মনে হয়, এখন এ দুই শক্তির পথযাত্রা ও কৌশল বেশখানিকটা ভিন্নমুখী হতে শুরু করেছে। এর প্রভাব আগামী দিনে পড়তে পারে।

বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার সাথে ২০০৭ সালের অবস্থার বেশখানিকটা মিল রয়েছে। এর কাছাকাছি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৪ সালেও। তখনকার বিরোধী জোটের কাছে প্রতিবেশীর ইচ্ছার সাথে সমঝোতা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল আমিরাতের পক্ষ থেকে। এ ব্যাপারে ‘সহায়তা’র কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারপারসন সে প্রস্তাবে সাড়া দেননি। অন্য দিকে তাদের সাথেই সমঝোতা করেছে সরকার পক্ষ। তখন এক বছর পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত পুরো মেয়াদই ক্ষমতায় থেকে যেতে সক্ষম হয় ‘বিজয়ী’ জোট।

২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতার পরিবর্তন ইস্যু আবারো সামনে চলে আসে। এবার সমঝোতা ও দরকষাকষিতে আবির্ভূত হয় চীনও। কঠোর চীনা সমর্থনে ‘মধ্যরাতের’ একতরফা নির্বাচন হয়ে যায়। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, সোনার নৌকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম অভিনন্দন জানান চীনা রাষ্ট্রদূত। এরপর গমন করেন ভারতীয় হাইকমিশনার। এ নির্বাচনের এক বছরপূর্তিতে এখন চলছে আরেক ক্রান্তিকাল। চীন ও ভারত দুই দেশই তাদের প্রতিশ্রুত পাওনা বুঝে নিতে চাইছে। অভিযোগ, একপক্ষ বাধ্য করছে সাবমেরিন কিনে ঘাঁটি করার উদ্যোগে। অন্যপক্ষ, উপকূল অঞ্চলব্যাপী রাডার বসানো আর দুই প্রধান বন্দর ব্যবহারের কার্যকর চুক্তি করতে ‘বাধ্য করেছে’। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব বোয়িং রক্ষণাবেক্ষণ স্টেশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। এ নিয়ে রশি টানাটানিতে আবার এক টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রতিটি পক্ষ যার যার পাওনা বুঝে নিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় চাপ প্রয়োগের উপাদানগুলোকে এখন সক্রিয় করে তুলেছে। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও জনসমর্থনহীন সরকার থেকে সুবিধা গ্রহণের জন্য চেপে ধরার মতো পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে। এখানে অভ্যন্তরীণ প্রেসার গ্রুপগুলোর চেয়েও বৈশ্বিক শক্তি কেন্দ্রগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে সমঝোতায় যেতে পারলে অভ্যন্তরীণ অনেক অবস্থা পাল্টে যায়। সেই সমঝোতার সূত্রগুলো বর্তমান সরকারের সামনে অন্যদের চাইতে বেশি স্বচ্ছ মনে হয়। এই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর আরব আমিরাত সফর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ভারত মার্কিন সৌদি ইসরাইল, এই চার পক্ষের সাথে সমঝোতা আলোচনার কথা জানা যায়। আর এতে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে এমন রাষ্ট্রশক্তির। যে দেশটিকে বাংলাদেশ এখনো স্বীকার করে না।

এই অঞ্চলে ‘শিঙল্যাং ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার যে দাবি এক সময় উত্থাপন করা হয়েছিল, সেটি দেশটির কর্ম পরিকল্পনার কার্যকর তালিকায় আছে কি না জানা যায়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মুসলিম ইস্যুতে মোদি সরকারের স্বার্থের সাথে ইসরাইলের সাধারণ কিছু স্বার্থগত মিল থাকলেও দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা নয়। কথিত শিঙল্যাং ইসরাইল তথা একটি ইহুদি বাফার স্টেট প্রতিষ্ঠা করা হলে সেটি প্রধানত ভারতের উত্তর-পূর্বাংশেই মিজোরাম-মনিপুরে হওয়ার কথা। এর সাথে দু’পড়শি দেশের অংশবিশেষ যুক্ত হলেও এটি সবচেয়ে বড় হুমকি হবে খোদ ভারতের জন্য।

এ বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে যে বোঝাপড়া, তাতে ভারত ও ইসরাইল- দুই দেশের প্রতিনিধিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হয়তো বা রাখতে চায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি। এই ইস্যুতে আপস করে কাউকে ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে দেয়া হলে তা একপর্যায়ে পলাশীর বিপর্যয়ের মতো পরিণতি নিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।

– ফেসবুক থেকে নেয়া…

mrkmmb@gmail.com