সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে হলমার্কের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এসব মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেওয়া হয় এক বছর পর ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর। এর পর আট বছর পেরিয়ে গেছে একটি মামলার রায়ও হয়নি। বিচারকাজ স্থবির হয়ে আছে। এমন অবস্থাতেই ৯ বছর ধরে কারাগারে আছেন প্রধান অভিযুক্ত, হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ। এক বছর পর তিনি এসব মামলার সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ পূর্ণ করবেন। কারণ দুদকের মামলায় সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
অবশ্য আইনবিদরা বলছেন, একই প্রকৃতির অভিযোগ হওয়ায় ১১ মামলায় তানভীর সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাভোগ করবেন, নাকি একেকটি মামলায় ১০ বছর করে কারাভোগ করবেন, নাকি কম সাজা বা খালাস পাবেন তার আদেশ আদালতই দেবেন।
সূত্র জানায়, আদালতে চার্জশিট দেওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে মামলাগুলোর বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। ১১ মামলার ৭৮ সাক্ষীর মধ্যে ৫০-৫৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম আর এগোয়নি। ১১টি মামলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১-এ বিচারাধীন রয়েছে।
দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক বলেন, অনেক সময় পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) ও তদন্ত কর্মকর্তারা তৎপর না হলে মামলার বিচারিক কাজ বিলম্ব হয়ে থাকে। হলমার্কের বিরুদ্ধে করা ১১ মামলার বিচারিক কাজ কেন বিলম্ব হচ্ছে সেটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তবে মামলাগুলোর বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে যখন মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম চলার সময় আমমোক্তার মো. মাহবুবুল আলম হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদের পাওনা পরিশোধে শর্তযুক্ত জামিন, কারখানার যন্ত্রপাতি ধ্বংস থেকে রক্ষা এবং ৪০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের স্বার্থে কারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন জমা দেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় সরকারের সঙ্গে হলমার্কের প্রতিনিধির যোগাযোগ হয়। উভয়পক্ষের যোগাযোগে ব্যাংকের লোপাট হওয়া টাকা আদায়ের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। ওই সময় থেকেই ১১ মামলার বিচারকাজে ভাটা পড়ে।
দুদকের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আইন অনুযায়ী বিশেষ জজের অধীনে দুদকের মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এই মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকা মহানগর আদালতে দশজন বিশেষ জজ রয়েছেন। বিশেষ জজগণ দুদকের মামলার পাশাপাশি অন্যান্য মামলাও পরিচালনা করছেন। তাতে দুদকের মামলার বিচারকার্যে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দুদক সূত্র জানায়, হলমার্ক কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা মোট ২,৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার মধ্যে ফান্ডেড ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা দুদকের মামলায় তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ অন্য আসামিরা বর্তমানে জেলে আছেন। ব্যাংকিং খাতের সর্ববৃহৎ এই জালিয়াতির ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির ও সোনালী ব্যাংকের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল শাখার সাবেক ডিজিএম একেএম আজিজুর রহমানসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছিল মামলাগুলোতে।
তৎকালীন দুদক উপপরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে বিশেষ টিমের সদস্যরা বাদী হয়ে ওই ১১টি মামলা করেছিলেন।
কথা রাখেনি হলমার্ক :হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা করে দেনা পরিশোধের শর্তে আদালত থেকে জামিন নিয়েছিলেন ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট। এর পর তিন বছর তিনি কারাগারের বাইরে ছিলেন, কিন্তু এক টাকাও পরিশোধ করেননি। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার করা হয় ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর।
সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা ১১ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জেসমিন। সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর আদালতের তৎকালীন দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জহুরুল হকের আদালত থেকে জেসমিনকে জামিনের আদেশ দেওয়া হয়েছিল গত ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। একই বছরের ৫ আগস্ট একই আদালতে শুনানির পর প্রতি মাসে একশ কোটি টাকা পরিশোধের শর্তে জেসমিনকে জামিনে মুক্ত করা হয়। জেসমিন ইসলামের জামিন মঞ্জুর করা সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জহুরুল হক বর্তমানে দুদক কমিশনারের (তদন্ত) দায়িত্বে আছেন।
তানভীর মাহমুদের কারাভোগ :দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ওই ১১ মামলায় হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০১২ সালের ৮ অক্টোবর। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ৯ বছর কারাভোগ করেছেন। দুদকের মামলায় সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এক বছর পর তানভীর মাহমুদের দশ বছরের কারাভোগ শেষ হবে।
একজন আইনবিদ বলেন, শেষ পর্যন্ত তানভীর মাহমুদের সাজার কী হবে, কিংবা কীভাবে হবে সেসব বিষয় আদালতই চূড়ান্ত করে দেবেন।
সম্পদ অরক্ষিত :হলমার্কের অনেক সম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যে ১৩৭.৪৬ একর জমির দলিল সোনালী ব্যাংকের কাছে রয়েছে। তবে কিছু জমি ব্যাংকের নজরদারির বাইরে রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। শিল্প-কারখানার ভবন, শেড, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সম্পদ ৯ বছর ধরে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে পেশ করা হলমার্কের এক আবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পে উৎপাদন বন্ধ থাকায় তাদের ৫০০ কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি, পাঁচ হাজার ছয়শ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ি-গরু বেহাত :দুদকের হিসাব থেকে জানা গেছে, হলমার্কের ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৮৪টি গাড়ির হদিস নেই। নামি-দামি ব্র্যান্ডের জিপ, প্রাইভেটকারগুলো কোথায় আছে, কীভাবে আছে তারও কোনো হদিস নেই। হলমার্কের একটি খামারের পাঁচ হাজার গরু বেহাত হয়ে গেছে। পাঁচ হাজার গরুর মধ্যে এক হাজারটি গাভি ছিল। এক হাজার গাভি থেকে দৈনিক ৮০০ লিটার দুধ পাওয়া যেত, যা মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বনফুলকে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন এসবের কিছুই নেই। – সমকাল