‘বিলেটের বাজার লাখো কোটি টাকার’

 

বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও গুণগতমান ভালো হওয়ায় এবার বিলেটের পঞ্চম চালান রপ্তানি করলো জিপিএইচ ইস্পাত। সর্বশেষ চালানে ১৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ২৯ হাজার ৬৫৮ টন বিলেট চীনে পাঠিয়েছে তারা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এই চালান নিয়ে ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে গেছে জিপিএইচ ইস্পাতের জাহাজটি। এর আগে একই প্রতিষ্ঠান চার ধাপে মোট ৪২৫ কোটি টাকা মূল্যের আরো প্রায় ৯০ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করেছে চীনে।

পাঁচ বাধার কারণে ইস্পাতের লাখো কোটি টাকার বিশ্ব বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। লাল-সবুজের এই দেশ থেকে চীনে প্রতিটন বিলেট রপ্তানি করতে এখন জাহাজ ভাড়া দিতে হয় ৬০ থেকে ৭০ ডলার। অথচ একই পণ্য চীনে রপ্তানি করতে ভিয়েতনাম দিচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ ডলার। ভারতের লাগছে ৩৫ থেকে ৪০ ডলার। শুধু জাহাজ ভাড়া নয়; পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও পাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি বাংলাদেশে। তবুও এসব প্রতিকূলতার মাঝেও জিপিএইচ ইস্পাত গর্বের সঙ্গে বিলেটের পঞ্চম চালান রপ্তানি করেছে।

ছয় মাসে পাঁচটি চালান রপ্তানি করা প্রসঙ্গে জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‌‘বিলেট রপ্তানি করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। তারপরও লাল সবুজের পতাকাকে বিশ্ব বাজারে দেখতে চাই। তাই বিলেটের পঞ্চম চালান নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে গেছে আমাদের আরেকটি জাহাজ। তবে বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে হলে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে সরকারকে। তাহলে ইস্পাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার লোকের নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারবো আমরা।’

বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও ব্যবসা উন্নয়ন) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভিয়েতনামের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে প্রতিটন বিলেট রপ্তানি করতে হচ্ছে আমাদের। ভারতের তুলনায়ও দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হচ্ছে। আবার প্রতিটন কাঁচামাল খালাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর দিতে হয়। আমদানিকৃত কাঁচামালের যে অংশটুকু রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হবে সেটির ডিউটি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলে আমাদের উৎপাদন ব্যয় আরও কমতো। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি আমরা। নিজস্ব সাবস্টেশন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করছি এখন। অথচ ঘণ্টায় যে কারখানা মাত্র ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে তার চেয়ে এক বিন্দু বেশি সুবিধা পাচ্ছি না আমরা। বৃহৎ কারখানা হিসেবে আমাদের বিদ্যুতের দাম কিছুটা কম হলে ভালো হতো। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও প্রণোদনা পেতে পারে জিপিএইচ ইস্পাত। সরকার এসব বিষয় বিবেচনা করলে আমাদের উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। বিশ্ববাজারেও আমরা বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত করতে পারবো।’

যে চীন থেকে একসময় বিলেট আমদানি করে রড তৈরি করা হতো; সেই চীনেই এখন বিলেট রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো চীনে ২৫ হাজার টন বিলেট পাঠায় বাংলাদেশের জিপিএইচ গ্রুপ। এরপর ২০ হাজার টন করে দু দফায় ৪০ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করে লাল-সবুজের দেশ। গত মে মাসে চতুর্থ চালানে ২৫ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করে জিপিএইচ ইস্পাত। সর্বশেষ পঞ্চম চালানে তারা সর্বাধিক সাড়ে ২৯ হাজার টন বিলেট পাঠায় চীনে।

বিলেটের লাখো কোটি টাকার বাজার ধরতে চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, তুরস্ক, ব্রাজিল, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও ইউক্রেনের সঙ্গে এখন প্রতিযোগিতায় আছে বাংলাদেশও। প্রসঙ্গত, রড উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল হলো বিলেট। এটি উত্তপ্ত করে ছাঁচে ফেলেই রড তৈরি করা হয়। বিলেট উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্বে দিচ্ছে এখন চীন। মোট বাজারের প্রায় অর্ধেক এখন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।

ইস্পাত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বে বিলেটের বাজার লাখো কোটি টাকার। এই বাজার ধরতে রপ্তানির উপর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ প্রণোদনা চায় তারা সরকার থেকে। এটির পাশাপাশি সমুদ্র বন্দরে বার্থিং ও সড়ক পরিবহনে চান তারা অগ্রাধিকার। বিলেট উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে গ্যাস ও বিদ্যুতের। এই দুটি বিষয় সহজলভ্য হলেও বিলেট রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। আর এটি বাড়লে পাল্টে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিও।

জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ইতোপূর্বে বলেছিলেন, ‘ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস কোয়ান্টাম বা ইএএফ কোয়ান্টাম ইস্পাত শিল্পের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এর চেয়ে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি এখনও আবিস্কার হয়নি। পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী এ প্রযুক্তিতে একই জ্বালানিকে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। তাই জ্বালানির অপচয় হয় না বললেই চলে। এটি কারখানার উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও কম হয়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বলে এতে সর্বোচ্চ মাত্রায় পণ্যের মানও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করেছি বলেই চীনে বিলেটের পঞ্চম চালান রপ্তানি করতে পেরেছি আমরা। এটির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। সরকার থেকে নীতি সহায়তা পেলে বিলেটের লাখো কোটি টাকার বিশ্ব বাজারে আরও বড় পরিসরে প্রবেশ করতে পারবো আমরা।’

জানা গেছে, বিশ্বে ইএএফ কোয়ান্টাম প্রযুক্তির একটি করে ইস্পাত কারখানা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোথাও একই সঙ্গে উভয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। জিপিএইচ ইস্পাতই প্রথম একই ছাদের নিচে ইএএফ কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে। জিপিএইচের সম্প্রসারিত নতুন কারখানাটি হচ্ছে একক শেডের নিচে দেশের সবচেয়ে বড় ইস্পাত কারখানা। একই সঙ্গে দেশে বেসরকারি খাতে কোনো একক প্রকল্পে এটিই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যানুযায়ী, ছয় বছর আগেও চাহিদার ৬০ শতাংশ বিলেট আমদানি করতে হতো। দেশে উৎপাদিত হতো ৪০ শতাংশ। আর এখন উল্টো রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এটির নেপথ্যে কাজ করেছে সরকারি একটি সিদ্ধান্ত। চার বছর আগে বিলেট আমদানিতে শুল্কহার বাড়িয়ে দেয় সরকার। এজন্য নতুন নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। মনোযোগ দিয়েছেন কারখানার আধুনিকায়নেও। এতে করে বিলেট উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বজায় রাখতে পারছে মানও। এখনও রপ্তানি উৎসাহিত করতে যুগান্তকারী এমন সিদ্ধান্ত চান এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন- রপ্তানি পণ্যে সর্বোচ্চ প্রণোদনা পেলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত হবে। দেশে বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে ২১০টি এম এস পণ্য উৎপাদনকারী মিলস রয়েছে। তার মধ্যে ৪২টি প্রতিষ্ঠান স্ক্যাপ থেকে বিলেট এবং বিলেট থেকে এম এস রড উৎপাদন করে থাকে। প্রায় ৬৩ টি প্রতিষ্ঠান ৪০ গ্রেড রড উৎপাদন করে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শিপ ব্রেকিং পেতে সরাসরি রড, অ্যাঙ্গেল ও বার উৎপাদন করে থাকে। ইবিএলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবুল খায়ের, বিএসআরএম, জিপিএইচ ও কেএসআরএম বিলেট সক্ষমতার ৯০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে; যা দেশের বার্ষিক চাহিদার ৫০ শতাংশের বেশি।