অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩ শতাংশ। কৃষি খাতেই কর্মসংস্থান রয়েছে শ্রম বাজারের প্রায় ৪২ শতাংশ। করোনা মহামারিতে কৃষি খাত সচল থাকায় বাংলাদেশকে খাদ্য সংকটে পড়তে হয়নি। এলডিসি পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকার আসনে বসতে পারে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ।
কৃষিপণ্য বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে বর্তমান ধান, গম, সবজি ও দেশীয় ফলমূল উৎপাদনের বাজার দ্বিগুণ করা সম্ভব। কৃষির নতুন নতুন খাত চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা, পরিবহন, বীজ তৈরি, সার, পানি কম অপচয় করে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। এসব খাতে বিনিয়োগ করতে পারলে কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ দ্রুত করা সম্ভব বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজন্য প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ। এ বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ দেশীয় উৎস থেকে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সরকারি নীতি সহায়তা।
তথ্য বলছে, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন তিন হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী। যদিও তাদের সবার কৃষিতে কর্মসংস্থান হয় না। আর কৃষিপণ্য বাজারজাত ও ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশে বর্তমানে এক লাখ ৬০ হাজার কেন্দ্র রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আড়ত, হাট, কাঁচা বাজার ও অস্থায়ী দোকানপাট।
বর্তমানে প্রতি বছর দেশে শুধু শাকসবজির উৎপাদন হচ্ছে এক কোটি ৬০ লাখ টন। শুধু মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে ৪৫ লাখ টন। আবার দানাদার জাতীয় খাদ্য পণ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রতি বছর চার কোটি ৪০ লাখ টন। এছাড়া গোশত ৮৫ লাখ টন ও দুধ উৎপাদন হচ্ছে এক কোটি ২০ লাখ টন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ও কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘ক্রমান্বয়ে আমরা এগিয়েছি। এখনও এগিয়ে যাচ্ছি। এক সময়ে ভুট্টা উৎপাদন অনেক কম হতো। এখন চাহিদার প্রায় পুরোটাই উৎপাদন হচ্ছে। ভুট্টা তো বাজারের জন্য উৎপাদন করছেন কৃষকরা। গত ১০-১২ বছরে কৃষি খাত যথেষ্ট এগিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে হারিয়ে যাওয়া অনেক ফলই নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে প্রচুর ফল রয়েছে। শাকসবজি পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন বেড়েছে বলেই সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। কৃষিতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ শুরু হয়েছে। এসব উৎপাদন তো শুধু উৎপাদকের জন্য নয়, বাজারের জন্য। এখন সারাদেশেই কৃষিপণ্য বাজারজাত হচ্ছে। এটিই কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ। এজন্য করোনা মহামারিতেও আমরা খাদ্য সংকটে পড়িনি।’
এ কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাণিজ্যিকীকরণ তো শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। সামনের দিকে আরও আসবে। যেমনÑআমাদের লিচু ও আম উৎপাদন প্রচুর হয়। এক সময়ে দেখা যাবে সারা বছর আম ও লিচু পাওয়া যাচ্ছে। এখন যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ। এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগের সুযোগ আছে। দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে অনেকেই। সময়ের আলোকে তা বৃদ্ধি পাবে। দেশীয় উদ্যোক্তারা সফল হলে তবেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবে। অনেকে হয়তো নতুন বিনিয়োগ করবে, আবার কেউ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আসবে। এভাবেই কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ হবে এক সময়ে। এখানে প্রচুর সুযোগ রয়েছে কর্মসংস্থানেরও।’
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসিআই এগ্রোবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. এফএইচ আনসারি একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, কৃষি গবেষণার প্রায় পুরোটাই এখনও সরকারি ও দাতা সংস্থা নির্ভর। কৃষি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা, নতুন জাতের উদ্ভাবন ও উচ্চফলনশীল জাত তৈরিতে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বীজ ও আধুনিক কৃষি খামার খাতে এমন সুযোগ রয়েছে। এখানে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে।
কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে কৃষি খাতে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে কয়েকটি খাতে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা, পরিবহন, বীজ তৈরি, সার, পানি কম অপচয় করে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ, কৃষি যোগাযোগ, কৃষিপণ্যের তথ্য ভাণ্ডার, প্রাণিজ আমিষের উন্নয়নে।
গবেষণা বলছে, শুধু সার উৎপাদনেই সম্ভাবনা রয়েছে দেশে। বর্তমানে দেশে রাসায়নিক সারের বাজার হচ্ছে ১৫৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের, অর্গানিক বা জৈব সারের বাজার হচ্ছে এক কোটি ২০ লাখ ডলারের, মাইক্রো নিউট্রেশনের বাজার হচ্ছে তিন কোটি ডলারের। প্রতি বছর এসব খাতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৯ শতাংশ করে। এসব খাতে বিনিয়োগ করে কয়েক বছরের মধ্যে বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। খাতগুলোর স্থানীয় বাজার রয়েছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য বাজারে আনলেই লাভবান হতে পারবেন উদ্যোক্তারা।
গবেষকরা বলছেন, কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে যন্ত্রচালিত ট্রাক্টরের ব্যবহার বাড়ছে। চাষের পাশাপাশি বীজ রোপণ, ফসল কাটা, মাড়াই ও পরিবহন কাজে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে কৃষকরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। ফলে কৃষিতে তরুণরাও এগিয়ে আসছে।
শুধু কৃষিযন্ত্রের বাজার হচ্ছে সাড়ে সাত কোটি ডলারের। এর মধ্যে খুচরা যন্ত্রাংশের বাজার হচ্ছে ছয় কোটি ডলারের। প্রতি বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৯ শতাংশ করে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যন্ত্রের বাজারকে আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব।