অপরাধ করে শাস্তি পেলেন ‘মুসলিম আইন প্রণেতা’

৪৬ বছর বয়সের এক লোক হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। তাকে কষে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। আশপাশে থাকা জনগণ ব্যাপারটি দেখে মুখ ভার করে আছেন। লোকটি বেতের আঘাতের ব্যথায় চিৎকার দিয়ে কখনও দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু থামছে না বেতের আঘাত। ব্যথায় লোকটি চিৎকার করলে বিদ্রূপের হাসি শোনা যায়, উপস্থিত মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু বেতের আঘাত থামেনি। একে একে ২৮টি আঘাত করেই তবে তাকে ছাড়া হয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে।

ইসলামি আইন লঙ্ঘন করায় ওই লোককে সবার সামনে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। শাস্তির মুখে পড়া লোকটি একজন মুফতি। তিনি আচেহ উলামা কাউন্সিল (এমপিইউ)-এর সদস্য। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের দায়ে তাকে এমন শাস্তি ভোগ করতে হলো প্রকাশ্যে। মুখলিস বিন মোহাম্মদ নামের ওই আইন প্রণেতা মুফতিকে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) ২৮টি বেত্রাঘাত করা হয়েছে। আর তার সঙ্গে সম্পর্কিত নারীকে ২৩টি বেত্রাঘাত করা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে সবাইকে শরিয়া আইন মেনে চলতে হয়। সেখানে জুয়া খেলা, মদ পানের জন্য বেত্রাঘাতের মতো শাস্তির মুখে পড়তে হয়। দেশটিতে বিয়ে বর্হিভূত সম্পর্কের শাস্তি প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত।

শরিয়া আইন পরিপালন, আইনের খসড়া প্রণয়নসহ নানা কাজে সহায়তা দেয় আচেহ উলামা কাউন্সিল (এমপিইউ)। কাউন্সিলের সদস্যদের সবাই মুফতি। ইসলামি আইনশাস্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা এবং ইসলামের আলোকে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদানকারীকে মুফতি বলা হয়।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানিয়েছে, দেশটিতে শরিয়া আইন চালুর পর এই প্রথমবার কোনো মুফতি প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের শাস্তি পেলেন।

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ কঠোর রক্ষণশীল ইসলামিক বিধান প্রচলনের বিশেষ ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। ২০০৫ সাল থেকে এই প্রদেশে চালু রয়েছে শরিয়া আইন। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের পাশাপাশি সমকামিতা ও জুয়ার শাস্তিও সেখানে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত। সরকারকে এই আইন কার্যকর করতে পরামর্শ, সার্বিক সহযোগিতা দেয় এমপিইউ।

মুখলিস আচেহ প্রদেশের বেসার জেলায় থাকেন। সেপ্টেম্বর মাসে এক বিবাহিত নারীসহ তাকে একটি পর্যটন উপকূলের পার্ক করা একটি গাড়ি থেকে আটক করে কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার তাদের বেত্রাঘাত করা হয়। পরে মুখলিসকে এমপিইউ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

বেসারের ডেপুটি মেয়র হুসাইনি ওয়াহাব এ বিষয়ে বলেন, ‘এটা আল্লাহর আইন। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে, সে উলামা কাউন্সিলের সদস্য হলেও। ইসলাম তো কারো মুখ, বংশ, পদ-পদবি দেখে বিচার করে না। বিচার করে অপরাধীর। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য্য।’

আচেহ প্রদেশে ২০১৪ সালে সমকাম বিরোধী আইন পাস হয়। আর পরের বছর থেকেই সেখানে ওই আইন কার্যকর শুরু হয়। শরিয়া আইন অনুযায়ী বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, জুয়া, মদপান, অ্যালকোহল উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ।

২০১৭ সালে সমকামিতার দায়ে সেখানকার দুইপুরুষের প্রত্যেককে ৮৩টি করে বেত্রাঘাত করা হয়।

যে ব্যক্তি বেত্রাঘাতের শাস্তি কার্যকর করে, তার পরিচয় গোপন রাখতে চোখ ছাড়া সম্পূর্ণ দেহ ঢেকে রাখা হয়। উন্মুক্ত স্থানে বানানো মঞ্চের ওপর এই শাস্তি কার্যকর করা হয়। তবে শিশুদের সেখান থেকে দূরে রাখা হয়। আচেহ প্রদেশে বসবাসরত মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্যই শরিয়া আইন প্রযোজ্য।

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম এই প্রদেশেই ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রদেশটির রাজধানীর নাম বান্দা আচেহ। আয়তন ৫৮ হাজার ৩৭৫ দশমিক ৮৩ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৬০ লাখের মতো।

শতকরা ৯৮ দশমিক ৬ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশটিতে ২০০১ সালে ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসন’-এর ব্যবস্থার পর ইসলামি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরে ২০০৫ সালে শান্তিচুক্তি সই হওয়ার পর শরিয়া আইনের প্রয়োগ আরও জোরালো হয়।