হুমায়ুন আহমেদের শিল্পকর্ম

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল :

হুমায়ুন আহমেদের একজন বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক থেকে রূপান্তরিত হলেন সাহিত্যিক হিসেবে। রসায়নের রসের চেয়ে সাহিত্যের রসই আস্বাদন করলেন আমৃত্যু। কথাসাহিত্যের অপূর্ব পেখম মেলে, সতীর্থদের ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার হিমালয় গড়লেন। নন্দিত নরক থেকে নিউ ইয়র্কের আকাশে জ্বলমলে রোদ পর্যন্ত ৩২২টি গ্রন্থের জনক হুমায়ুন আহমেদ। পাশাপাশি ছয়টি চলচ্চিত্র, অসংখ্য নাটক এবং গান রচনা করে আমাদের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। গল্প-উপন্যাসের প্রয়োজনে কিছু কবিতাও লিখেছেন। তাঁর ১০/১২টি কবিতার একটি গিফট কার্ডও বেরিয়েছিলো। আমার সম্পাদনায় ‘কথাশিল্পীদের কবিতা’ তাঁর একটি কবিতা চাইলে তিনি স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বলেন, তুমিই আমার নামে লিখে দাও। মনে আছে, ‘আমার একটি উপন্যাসে তোমার কবিতার ‘ছোট ফুফুর মতো ফুটফুটে রাত’ ব্যবহার করেছিলাম। পঙক্তিটা খুব ভালো লেগেছিলো’। তিনি নতুন কবিতা না দিলেও উক্ত সংকলনে তাঁর ‘কবি’ উপন্যাসের ‘বাবার চিঠি’ কবিতাটি নেয়ার অনুমতি দেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্প-কবিতা-গানের পাশাপাশি প্রচুর ছবি এঁকেছেন। সেই স নিয়ে গ্রন্থ বেরিয়েছে। কবি নির্মলেন্দু গুণও ছবি আকঁছেন। তা নিয়ে লিখেছিলাম- ‘২৫ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে তার চিত্র প্রদশর্নী চললো। ছবি বিক্রি হয়েছে ২৪টি, অর্থের পরিমাণ ৩ লক্ষ টাকা। বাকীগুলো বিভিন্ন জন এসে দেখছেন, কিনছেন। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় নিজ নামানুসারে ‘নির্মলেন্দু গুণ পাঠাগার ও সংগ্রহশালা’র কাজ শুরু করেছেন, বিক্রিত ছবির অর্থ দিয়ে’। (দ্রঃ ভালো রবীন্দ্রনাথ, মন্দ রবীন্দ্রনাথ/ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস, আগষ্ট ২৬, ২০০৯, টরন্টো, কানাডা।)

কবিদের পর এবার কথাশিল্পীর কথায় আসি। আমাদের হুমায়ুন আহমেদও জীবনের শেষদিনগুলোতে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী হন। এ প্রসজ্ঞে তার ভাষ্যঃ

ক] ‘আমেরিকায় সময় কাটানোর জন্য প্রচুর বই পড়তাম। একসময় বই পড়তে ভাললাগছিল না। তাই লেখালেখি শুরু করলাম। …লেখালেখি করতেও একসময় একঘেয়েমি চলে আসে। তখন রঙ কিনে একের পর একছবি আঁকতে শুরু করি। দেখলাম অসম্ভব ভাল ছবি আঁকা হচ্ছে’। (দ্রঃ লিখিয়ে থেকে আঁকিয়ে হুমায়ূন আহমেদ/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর, মে ১৫, ২০১২, ঢাকা।)

খ] ‘ছোটবেলায় আমরা সবাই ছবি আঁকি। তবে আমার ব্যাপারটা জেনেটিক কিনা, জানি না। আমার এক ভাই আহসান হাবীব তো উন্মাদ (কার্টুন পত্রিকা)এর সম্পাদক। আরেক ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল গণকন্ঠের ষ্টাফ কার্টুনিষ্ট ছিলো’। (দ্রঃ সাক্ষাৎকার/ দৈনিক ইত্তেফাক, ঈদ সংখ্যা ২০১২, ঢাকা।)

আঁকতে আঁকতে প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছবি আঁকলেন। সেই ছবিগুলো নিয়ে তিনদিনব্যাপী একটা প্রদর্শনী হলো- মুক্তধারার বইমেলার ২৯, ৩০ জুন এবং ১ জুলাই নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় ১৮২ স্ট্রিট এবং হিলসাইড অ্যাভিনিউতে অবস্থিত স্যুসান বি এন্থনি হাইস্কুলের এক্সিবিট হলে।

প্রথমে ৪০টি ছবি নিয়ে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চললেও শেষ স্থান পায় কুড়িটি ছবি। কারণ, ২/১ ছবি অসমাপ্ত, কিছু ছবিতে স্বাক্ষর করেন নি। এখন ছবিগুলোর হদিস মিলছে না। কাগজে খবর বেরিয়েছে-

…‘হুমায়ূনের শেষ জীবনে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলো কার হেফাজতে রয়েছে? কারণ যতদূর জানা গেছে, যে তার পরিবার দেশে যাবার সময় এসব নিয়ে যেতে পারেনি, কারণ তা তাদের হেফাজতে ছিল না। একটি সূত্র দাবি করেছে, এই চিত্রকর্মগুলো নিয়ে রীতিমত একটি চুলোচুলি ঘটনাও নাকি ঘটেছিল। মৃত্যুর পর হুমায়ূনের সৃষ্টি এই চিত্রকর্ম নি:সন্দেহে এখন মহামূল্যবান সম্পদ। কিন্তু এই মহামূল্যবান চিত্রকর্মগুলো কে হাতিয়ে নিয়েছে তা এখন সবার কাছে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। … হুমায়ূনের চিত্রকর্মগুলো উদ্ধার করে তা যথাযথ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেয়া হয় “। (দ্রঃ নিউইয়র্কে শেষ জীবনে আঁকা হুমায়ূনের চিত্রকর্মগুলো কোথায়?/ সাপ্তাহিক বর্ণমালা, আগষ্ট ১২, ২০১২, নিউ ইর্য়ক।)

শুধু নিউ ইয়র্কেই নয়, বাংলাদেশেও অনেক ছবি এঁকেছেন কিন্তু কখনো এর আগে তাঁর আঁকা ছবিতে স্বাক্ষর করেননি। ছবিগুলো দুই ছেলের সাথে খেলতে খেলতেই আঁকা হয়েছিলো বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

কিন্তু এবার তিনি সিরিয়াস ভাবেই আঁকলেন এবং প্রদর্শণীর প্রস্তুতি নিলেন। প্রদর্শিত ছবিগুলো শিল্প রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি বইমেলার বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রদর্শনীতে অযত্নের ছাপ ছিলো। অনেকটা দায়সারা গোছের প্রদর্শনী। এতে কোনো নান্দনিকতার ছোঁয়া ছিলো না। কোনো ভাবে একটা শাদা কাপড়ে ছবিগুলো আটকানো ছিলো। নিচে পড়েছিলো আরো কিছু বাঁধাই করা শিল্পকর্ম। সেই সাথে স্বাক্ষরহীন বাঁধায় ছাড়াও কিছু শিল্পকর্ম। এই চিত্র দেখে শিল্পী সৈয়দ ইকবাল মন্তব্য করলেন, এই প্রদর্শণী ঢাকায় হলে ফাটাফাটি হতো। ছবিগুলোতে বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আরেক শিল্পী সুবীর চৌধুরী বলেন, ছবিগুলো দেখে রবি ঠাকুরের কথা মনে পড়লো। হুমায়ুন আহমেদ যেনো এমেচার শিল্পী নন; ভেতরে ভেতরে যেনো তিনি ছবি আঁকার প্রস্তুতি নিয়ে পূর্ণতা অর্জন করেছিলেন।

নিজের ছবি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ মূলত প্রকৃতি নিয়ে ছবিগুলো এঁকেছি। আমি অ্যাবষ্ট্রাক্ট লেভেলে যাইনি…। একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিলাম। একটা বিশাল কিছু হয়ে গেল; আমি এর মধ্যে নাই। প্রকৃতি নিয়ে কিছু কাজ করছি’। (দ্রঃ সাক্ষাৎকার/ দৈনিক ইত্তেফাক, ঈদ সংখ্যা ২০১২, ঢাকা।)

হুমায়ুন আহমেদের সব ক’টি চিত্রকর্মই জলরঙের আর তাঁর ক্যানভাস ছিলো শাদা কাগজ।গ্রাম-বাংলাসহ বিভিন্ন ধরনের ছবি তুলির আঁচড়ে মূর্ত হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ পাখি, প্রকৃতি, নদী, নিঃস্বর্গ ভালোবাসতেন। তাই মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন একটি মিনি বাংলাদেশ- নুহাশ পল্লী। নুহাশ পল্লী থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্র বিলাস তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। জয়নুল আবেদীনের ‘দু’টানা’ শিল্পকর্মটির কথা মনে পড়লো হুমায়ুনের আঁকা ছাগলের দৃশ্য দেখে। হুমায়ুন আহমেদের ভেতরে ছিলো এক বাউলেপানা, হিমু-মিসির আলীরা তাঁর প্রতীকী দৃষ্টান্ত। হুমায়ুনের শিল্পকর্মেও সেই প্রতীকীর গভীর প্রতিফলন ঘটেছে।

শিরোনামহীন শিল্পকর্মসমুহ যেনো একই সূত্রে গাঁথা। কোনো দুর্বদ্ধতা নেই, জটিলতা নেই। তাঁর গল্পের মতোই ছবিগুলোও ঝরঝরে। গ্রাম বাংলা, গ্রাম বাংলার নদী, নিসঃর্গ, নান্দনিকতায় পূর্ণ; পাশাপাশি প্রকৃতির মাঝে ফুটে আছে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা আর বেদনাবোধের চিত্র। নীলাকাশে এক একটু ভাসমান মেঘ, খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ বৃক্ষ, বেদনার নদীতে একটি নৌকা, দীর্ঘ পথে একাকী মানুষ, একটি প্রাচীন-পুরোনো ভাঙা বাড়ি যেনো শিল্পীর আত্মজীবনের প্রতিফলন।

saifullahdulal@gmail.com