হারিয়ে যাচ্ছে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ দেশি মাছ

 

 

ড. মাহফুজ পারভেজ

মাছের দেশের মানুষ আমরা সহজেই মাছের কথায় উদ্বেলিত হই। ভাতে-মাছে বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যের মতো মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মাছের কথা ও স্মৃতি।

বাংলাদেশের বহুবিচিত্র গন্ধ ও স্বাদের দেশি মাছ ক্রমশ বিলুপ্ত ও বিপন্ন হওয়ার উদ্বেগজনক খবর সবারই জানা। এসব খবরের পাশে কিছু আশাবাদী সংবাদও চোখে পড়ে মাঝে মাঝে। যেমন, দেশের বিভিন্ন স্থানে দেশি মাছের মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এমন খবর আশা জাগায়।

সন্দেহ নেই, এইসব আয়োজন দেশি মাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াবে এবং হারিয়ে যাওয়ার কবল থেকে বহু প্রজাতির মাছ রক্ষায় জনসচেতনতা আনবে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে একটি কথা বলতে হয়, আর তা হচ্ছে, নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই দেশি মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে বলিষ্ঠ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেই। দেশি মাছ রক্ষায় কিছু বেসরকারি উদ্যোগ দেখা গেলেও এ ব্যাপারে সরকারের মৎস্য বিভাগের উদ্যোগ খুবই দুর্বল। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ দেশি মাছ।

এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশি মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। দেশি মাছ বিলুপ্ত ও বিপন্ন হওয়ার এমন চিত্র শুধু উদ্বেগজনক নয়, হতাশাজনকও বটে।

দেশি মাছের আকাল ও বিপদের কথা মিডিয়া রিপোর্টে যেমন জানা যায়, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেও প্রতীয়মান হয়। দেশি মাছের ওপর পরিচালিত একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মেনি, পাবদা কালবাউস, ফলি, সরপুঁটি ও রুইসহ ৫৪ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। একদা যেসব মাছের প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল নদী, নালা, খাল, বিল, সেখানে এখন মাছের দেখা নেই।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অবাধ মাছ শিকার, বেপরোয়া কীটনাশক ব্যবহার ও কারখানার বর্জ্যজনিত দূষণের মধ্য দিয়েই দেশের মিঠা পানির দেশি মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এক সময় এদেশের নদ-নদী, খাল বিলে প্রচুর দেশি মাছের সমারোহ থাকলেও এখন নেই। নদীমাতৃক দেশ হওয়ার পরও দেশি মাছগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছেনা। মূলত পরিবেশ বিনাশী পদক্ষেপ ও খামখেয়ালির কারণেই মাছের বংশ ধ্বংস ও বিনাশ হচ্ছে।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, যেসব নদ-নদী এক সময় নানা জাতের দেশি মাছে পূর্ণ ছিল, এখন সেসব নদ-নদীতেই মাছ নেই। শুধু তাই নয়, এসব নদ-নদীর অনেকগুলোর চিহ্ন পর্যন্ত আজ অবশিষ্ট নেই। বহু প্রজাতির দেশি মাছের মতোই হারিয়ে গেছে মাছের আবাসস্থল অনেক নদী।

আরেকটি বিপদের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। দেশের সমস্ত মুক্ত জলাশয়ে অবাধে কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং সেচের মাধ্যমে মাছ শিকার এই অবস্থার জন্যে বিশেষভাবে দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে মাছচাষ এবং মাছ উৎপাদনে আগ্রহ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেশি মাছের চাষ ও সংরক্ষণের প্রতি কেউ আন্তরিক নয়, সবাই স্বল্প বিনিয়োগে চাষের মাছের মাধ্যমে বেশি মুনাফা লাভেই আগ্রহী।

ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি মাছ নয়, হাইব্রিড ধরনের মাছ উৎপাদনেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে সবাই। অথচ দেশি মাছই সবচেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এ তথ্য জানা থাকার পরেও দেশি মাছে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসছে না।

শুধু তাই নয়, দেশের কেউ কেউ দেশি মাছের সুরক্ষা এবং উৎপাদনে আগ্রহী হলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং মৎস্যবৈচিত্র্য সংরক্ষণে উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় তাদের আগ্রহেও ভাটা পড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, কেউ দেশি মাছ রক্ষায় বিশেষ কোনও ভূমিকা পালন না করার ফল পাওয়া যাচ্ছে চরমভাবে। মাছের অভাব ও বংশ নাশের মতো ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশ বিপর্যয়, নদী ও জলাভূমি দখলের পাশাপাশি দেশি মাছের প্রতি অমনোযোগ ও অবহেলা পুরো পরিস্থিতিকে নাজুক করেছে। অচিরেই হয়ত অনেক দেশি মাছ দেখাও যাবে না। নানা জাতের মাছের বৈচিত্র্যময়তাও আর থাকবে না।

দেশি মাছ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বিচিত্র স্বাদের ও পুষ্টির ভাণ্ডার দেশি মাছের স্থান কখনোই চাষের মাছ দিয়ে পূর্ণ করা যাবে না। লাভের ও বৃহত্তর মানুষের চাহিদা মেটাতে হাইব্রিড মাছ চাষ হোক। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে বিরাজমান দেশি মাছগুলোকেও বাঁচানো হোক।

এখনই যদি সতর্ক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বিলুপ্তির কবল থেকে অনেক প্রজাতির দেশি মাছকে রক্ষা করা হবে অসম্ভব। আমাদের গাফিলতি ও উদ্যোগহীনতার জন্য আমরা হারিয়ে ফেলবো নানা স্বাদ ও পুষ্টির দেশি মাছ। যা হবে খুবই ক্ষতিকর ও আত্মঘাতী।

প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।