চরে মারামারি করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের আঘাতে সরু বাঁশ ঘাড়ের পেছন দিয়ে ঢুকে মুখ দিয়ে রেব হয়ে গেছে বা পাঁচতলা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে রড ঘাড় দিয়ে ঢুকে মুখ দিয়ে বের হয়েছে। অথবা ডাকাত দল গলা কেটে নদী তীরে ফেলে দিয়ে সব নিয়ে চলে গেছে, এরপর মৃত ভেবে পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ২০ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর সেই ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠেছেন এরকম বেশ কিছু খবর বিগতদিনে গণমাধ্যমে আসার পর সারা দেশেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
কারণ তাদের বিভৎস ছবি যখন গণমাধ্যমে আসে তখন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিল তারা কোনোভাবেই সুস্থ হয়ে উঠবেন না। কিন্তু প্রত্যেকেই সুস্থ হয়েছেন এবং এখনও সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
এই সবগুলো ঘটনার সফল অস্ত্রোপচার করেন দেশের স্বনামধন্য নাক কান গলা বিভাগের সার্জন অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু। তিনি বর্তমানে মুগ্দা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি তার এ্যালিফেন্ট রোডের চেম্বারে গেলে দেশের সাড়া জাগানো সেই অস্ত্রোপচার করা সেই দুইজন রোগীর ছবি চোখে পড়ে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝে এরকম আরও বেশ কয়েকটি সফল অস্ত্রোপচার করেছেন বলে জানান ডা. মনিলাল আইচ লিটু। তারা প্রত্যেকেই এখন সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
ডা. মনিলাল জানান, প্রত্যেক সার্জন মানুষের জীবন বাঁচাতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। সব সময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। ২০০৮ সালে ফরিদপুরের নান্নু বেপারী যখন প্রতিপক্ষের আঘাতে আহত হন, তখন তার অস্ত্রোপচার করতে অনেকেই সাহস করেনি। আমার অভিজ্ঞতা তখন খুব বেশি না হলেও সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। নান্নু বেপারী প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেলে যায়, কিন্তু ডাক্তার তাকে ঢাকায় পাঠায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও একরকম অপারগতা প্রকাশ করলে এই রোগী আসে ধানমন্ডির সেলভেশন হাসপাতালে। সেখানে তার আত্মীয় স্বজনদের অনুরোধে আমি আরও চারজন চিকিৎসকের সহায়তায় ১২ ঘণ্টা চেষ্টার পর অস্ত্রোপচারে
সফল হই।
তিনি বলেন, এর ঠিক পরের বছরই ডেমরার সুলতানা নামে একজন গৃহপরিচারিকা প্রায় একই রকম আঘাত নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন। তখন আমি ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত ছিলাম। তবে তার অবস্থা নান্নু বেপারীর থেকে কিছুটা জটিল ছিল। কারণ সে পাঁচতলা থেকে তিনতলায় পড়ে যায়। আর তখনই একটি রড তার ঘাড় দিয়ে উড়না ও গলার চেইনসহ ঢুকে মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। উপর থেকে পড়ে যাওয়ায় তার শরীরে আরও বেশ কিছু আঘাত ছিল। এখানেও অনেকেই সাহস না করলেও পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমি ১০ ঘণ্টায় সফল হই।
ডা. মনিলাল বলেন, এরকম বিভৎস রোগী যখন হাসপাতালে আসেন তখন তাকে নিয়ে যে প্রচার প্রচারণা হয় ভালো হওয়ার পরেও একইরকম প্রচার প্রচারণা হওয়া উচিত। আমি এজন্যই বলছি যে, আমাদের দেশে উন্নত দেশের তুলনায় আধুনিক মেশিনারিজ না থাকলেও অনেক দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন যারা দক্ষতার সাথে সেই আধুনিক মেশিনারিজের অভাব অনেকটাই পুরণ করছেন। যার জন্য এসব রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর যদি আরও রিপোর্ট হয় তাহলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর সাথে সাথে কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে সাধারণ মানুষ তা জানতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় কান কেটে পড়ে গেছে রোগীকে আনা হয়েছে, আর এর কিছুক্ষণ পর রোগীর কান নিয়ে আসা হয়েছে এমন রোগীকেও ভালো করা হয়েছে বলে যোগ করেন ডা. মনিলাল।
মানুষের মাঝে একটি স্বাভাবিক ধারণা আছে যে, শ্বাসনালি কেটে গেলে তার বাঁচার সম্ভাবনা আর থাকে না। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় রোগীকে নেয়া হলে তাকেও বাঁচানো সম্ভব। এরকম একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, চাঁদপুরে ডাকাত দল সব লুট করে নিয়ে গলা কেটে এক ব্যবসায়ীকে নদী তীরে ফেলে যায়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসার পর প্রায় ২০ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর তাকে সুস্থ করে তোলা হয়।
অস্ত্রোপচারে তার দক্ষতা ও সফলতার জন্য দেশি বিদেশি অনেক সম্মানতার সাথে এবার ডা. মনিলাল আইচের নামের পাশে সম্মানসূচক এফআরসিএস (FRCS Glasg) যুক্ত হয়েছে। এ সম্মাননা ডিগ্রি পেয়ে তিনি দেশবাসী ও তার প্রিয় সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। সেই সাথে অনেক দক্ষ সার্জনও তৈরি করেছে। যার জন্য জোড়া মাথার যমজ বোন শিশু রাবেয়া ও রোকেয়াকে অস্ত্রোপচারে আলাদা করা, কোনো কাটাছেড়া ছাড়াই হৃদরোগের অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়েছে। রাবেয়া ও রোকেয়ার অস্ত্রোপচারের পর এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকরা জটিল অস্ত্রোপচারে যেনো আরও নজর দেয় সেজন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে জটিল অস্ত্রোপচারগুলো যেনো দেশেই করা যায় সেজন্য ইতোমধ্যেই সরকারও বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।