শিশুশ্রম বিলোপ না হলে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি ফিরবে না

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) বা রফতানিতে অগ্রাধিকার সুবিধা স্থগিত করা হয় ২০১৩ সালে। কাঙ্ক্ষিত জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল তার অন্যতম হলো শিশুশ্রম বিলোপ করা। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, শুকনো মাছ ও ইট উৎপাদনে শিশুশ্রম বিদ্যমান বলে উঠে এসেছে মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে। সেখানে এ শ্রমকে বিপজ্জনক ও নিকৃষ্টতম বলে উল্লেখ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান, বাণিজ্য এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয় ফাইন্ডিংস অন দ্য ওর্স্ট ফর্মস অব চাইল্ড লেবার (টিডিএ রিপোর্ট) শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিশুশ্রমের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ধরনগুলো বিলুপপ্তির ক্ষেত্রে ২০২০ সালে বাংলাদেশ মধ্যম পর্যায়ের উন্নতি করেছে। তবে এখনো শুকনো মাছ ও ইট উৎপাদনের মতো খাতে জোরপূর্বক শিশুদের ব্যবহার করা হয়। সেখানে তারা শিশুশ্রমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনগুলোর শিকার হয়। এছাড়া পোশাক ও চামড়াজাত সামগ্রী সরবরাহসহ একই ধরনের কাজের ক্ষেত্রগুলোতে শিশুরা বিপজ্জনক কাজ করে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আনুষ্ঠানিক এসব খাত ছাড়াও অনানুষ্ঠানিক বেশকিছু খাত যেমন—জাহাজ ভাঙা শিল্প, ভিক্ষাবৃত্তি ও গৃহপরিচারকের কাজ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশের আরো উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।

আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে নিকৃষ্টতম শিশুশ্রম বিলোপ করতে হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হলে তা দেশটিকে জানাতে হবে। এজন্য প্রতিবেদনে উল্লেখিত আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রম বিলোপের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এবং এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ও মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যকার আলোচনা ও সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, বর্তমানে দেশে ১২ লাখ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এর মধ্যে চামড়া, জাহাজ ভাঙা শিল্পসহ ৩৮টি শিল্পে কর্মরত শিশুদের আমরা চিহ্নিত করেছি। এসব ক্ষেত্রে শিশুশ্রম নিরসনে চতুর্থ ধাপের কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে তিন ধাপে মোট ৯০ হাজার শিশু শ্রমিককে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এ শিশুদের ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চার মাসের দক্ষতা অর্জনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারপর তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, চতুর্থ ধাপে আমরা এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছি। এভাবে ধাপে ধাপে ২০২৫ সালের মধ্যে সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের ফিরিয়ে এনে তাদের স্বাভাবিক জীবন দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, সমাজকল্যাণ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্থগিত জিএসপি ফেরত পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শ্রমিকদের কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন সূচকে এমনকি শিশুশ্রম বিষয়েও উন্নয়ন করেছি। তার পরও এখনো তারা জিএসপির স্থগিতাদেশ তুলে নেয়নি। তবে শুধু জিএসপি ফেরত পাওয়াই নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই আমরা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ব।

এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে ২০১০ সালে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে নতুন করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। তবে শিশুশ্রম প্রতিরোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান কভিড-১৯ মহামারী। তাই শিশুশ্রম নিরসনে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে তা ব্যয় করতে হবে। অন্যথায় একের পর এক কর্মপরিকল্পনা করা হলেও শিশু শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত জিএসপি হলো একটি ট্রেডিং স্কিম। এর অধীন স্বল্প বা শূন্য শুল্কে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাঁচ হাজারের বেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের অনুমতি পায়। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধসের পর থেকে বাংলাদেশী পণ্যের জন্য জিএসপির বাণিজ্যিক সুবিধা স্থগিত রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় এ শিল্প বিপর্যয়ে ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর বেশির ভাগ ছিলেন পোশাক শ্রমিক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের পর বাংলাদেশ শ্রম অধিকারে গাফিলতির কারণে ২০১৩ সালে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। গত আট বছরে সেখানে যথেষ্ট উন্নতি হলেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর নির্দেশনা অনুসারে এখনো বাংলাদেশের শ্রম অধিকার ও শ্রম আইন সংশোধন হয়নি। এছাড়া যেসব খাতে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বিদ্যমান, সেগুলোও যথাযথভাবে নিরসন হয়নি। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করে এরপর আলোচনা শুরু করলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে।