বিশেষ ছাড়ের পরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ

ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমাতে চাইছে সরকার। ব্যাপক ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছে না খেলাপি ঋণে। ছয় বছর পর খেলাপি ঋণ আবার ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৬ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় যা ২২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা বেশি। আর তিন মাস আগের তুলনায় বেড়েছে ৪ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ঋণ ছিল ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। ঋণ প্রবৃদ্ধিতে এভাবে ধীরগতি থাকলেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে যেন লাগামহীনভাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কোনো কিছুকে উৎসাহিত করলে সেটা বেড়ে যায়। আর শাস্তি দিলে কমে যায়। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। যে কারণে সারাবিশ্বে ঋণখেলাপিদের শাস্তির মাধ্যমে খেলাপি কমানো হয়। আমাদের দেশেও তাই ছিল। তবে বর্তমান অর্থমন্ত্রী দুটি প্রক্রিয়ায় খেলাপিদের উৎসাহ দিয়েছেন। প্রথমত, খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছেন। যেখানে সুদহার মাত্র ৯ শতাংশ। এসব

কারণে নিয়মিত যারা টাকা পরিশোধ করতেন, তারা দেখছেন টাকা না দিলেই লাভ বেশি। ফলে কিস্তি না দিয়ে তারাও খেলাপি হয়েছেন। ফলে খেলাপি ঋণ না কমে বেড়েছে।

খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট বা এককালীন জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই পুনঃতফসিল পাওয়া প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সুদ নিতে পারবে ৯ শতাংশ। ব্যাংক চাইলে পুনঃতফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধা দিতে পারবে। ঋণখেলাপিদের জন্য এতসব সুবিধা দিয়ে গত মে মাসে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরকম নীতিমালার সমালোচনা করে আসছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।

মঙ্গলবার ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেন, এভাবে ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো আন্তর্জাতিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ নীতিমালার আওতায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন এসেছে পাঁচ হাজার ৪৬৩টি। এসব আবেদনের বিপরীতে ৪৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল চেয়েছেন খেলাপিরা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০৩টি আবেদন নিষ্পত্তি করেছে ব্যাংকগুলো। যার বিপরীতে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর বাইরেও অনেক ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ২১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকাররা জানান, সাধারণভাবে সেপ্টেম্বর ও মার্চে খেলাপি ঋণ বাড়ে। আর ডিসেম্বর ও জুনে কমে। তবে অর্থমন্ত্রীর ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধার ঘোষণার পর নিয়মিত টাকা দিতেন এরকম অনেকেই কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেন। পরবর্তী বিষয়টি আদালতে গড়ালে এরকম সুবিধার বিপক্ষে রায় দেন উচ্চ আদালত। ফলে অনেক দিন আবেদন নেওয়া বন্ধ ছিল। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আবেদন নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর উচ্চ আদালতের আদেশে সুবিধার জন্য নতুন করে আবেদনের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। আবার এ সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া যাবে বলে বলা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে যা ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গত জুনে ৫৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা হয়েছে। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা হয়েছে। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, বিশেষ নীতিমালার আওতায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খুব বেশি ঋণ পুনঃতফসিল হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুর পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদের প্রতি বৈঠকে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি করে আবেদন নিষ্পত্তি হচ্ছে। ফলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমবে।