চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং জাপানের পৃষ্ঠপোষকতায় ২৯টি মেগা কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ কার্বন বোমায় পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে চলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইংরেজি সংবাদমাধ্যম নিউ এজ।
বিশ্বব্যাপী এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মার্কেট ফোর্সেস এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থ্রিফিফটি ডট অর্গ (350.org) যৌথভাবে এই গবেষণায় অংশ নেয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে যে কয়লা চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে তা থেকে ২০৩১ সালের মধ্যেই ১১৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে অনলাইনে প্রকাশিত বুধবার এ ই গবেষণায় জানানো হয়, ৪০ বছর মেয়াদী এই বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে মোট ৪ হাজার ৬০০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। এই পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড জাপানের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশি। প্রসঙ্গত, বর্তমানে জাপানে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই কয়লা থেকে উৎপাদন করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা) এবং ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে প্রকাশ করে। ঢাকা রিপোর্টারস ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে এটি প্রকাশ করা হয়।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, চীন, ভারত, জাপান এবং যুক্তরাজ্য কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশে আগ্রাসী বিনিয়োগ নীতি অনুসরণ করছে। এসব দেশের চাপের কাছে বাংলাদেশও নতি স্বীকার করছে।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে চীন ১৫ টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। অপরদিকে যুক্তরাজ্য এবং জাপান তিনটি প্রকল্পে জড়িত রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প থেকে যথাক্রমে ৪ হাজার ৭০০ এবং ৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সরকার কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৩৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এটি বর্তমানের ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৬৩ গুণ বেশি।
গবেষণায় বলা হয়, ২৯ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ২৫ টিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর যে কয়লা আমদানি করতে হবে তার ব্যয় ২ বিলিয়ন ডলার।
উল্লেখ্য, গবেষকরা প্রস্তাবিত এসব প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাননি। কারণ বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছ এবং এতে অনেক পরিবর্তনও হবে। গবেষকরা জানান, প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে ১৮টি প্রকল্প নির্মাণে ৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে।
১৭টি প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চীনা প্রতিষ্ঠান এবং চীন সরকার শতকরা ৩০ ভাগের বেশি বিনিয়োগ করছে।
অপরদিকে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাজ্য। দেশটি শতকরা ১৪.৮ ভাগ পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সিঙ্গাপুর ৩.৪ শতাংশ, ভারত ৩.২ শতাংশ জাপান ২.৯ শতাংশ এবং মালয়েশিয়া ২.৯ শতাংশ অর্থায়ন করছে।
গবেষণায় বলা হয়, অবশিষ্ট ৪২.৩ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করবে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, ‘বিদেশি সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর জোট এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।’
গবেষকরা জানান, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের ১৫ টির বেশিরভাগ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে চীন সরকারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অথবা তাদের অধীনস্থ কোন সংস্থা।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বেশিরভাগ দায়িত্ব পেয়েছে চীনের সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়না।
এছাড়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়ার জন্য জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সবগুলোই নদী কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দক্ষিণ উপকূলের পায়রা, মাতারবাড়ি এবং মহেশখালিকে কেন্দ্র করে পাওয়ার হাব নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।
পরিবেশ দূষণকারী এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এই গবেষণা প্রতিবেদনে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখন এই কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে তা বাংলাদেশের জন্য আরো বিপদ ডেকে আনবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন গবেষকরা।