দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য উপযুক্ত জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এটি করা গেলে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার নিরসন হবে।
গতকাল রূপপুরে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে পারমাণবিক চুল্লি তথা রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন রাশিয়ার পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ।
রিঅ্যাক্টর ভবনের ভেতর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ও পরমাণুবিজ্ঞানী ড. মো. শৌকত আকবর রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির পর রিঅ্যাক্টর ভেসেলটি নকশা অনুযায়ী যথাস্থানে স্থাপন করা হয়। ৫-৬ মিনিটের মধ্যে এটি স্থাপন শেষ হয়। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্রটি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকের দিনটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমার ব্যক্তিগত জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। খুব আনন্দিত হতাম যদি সশরীর উপস্থিত থাকতে পারতাম। করোনা মহামারীর কারণে সেটি সম্ভব হলো না। তবে দ্রুতই আমি এখানে আসব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেও পাকিস্তান আমলের বঞ্চনার ইতিহাস জড়িত। তারা ধোঁকাবাজি করেছে। শুধু জমি বরাদ্দ করে। পরে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়।
জাতির পিতা স্বাধীনতার পর পরই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর নির্দেশনা মেনেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩ সালে রাশিয়া সফরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আমরা এ প্রকল্প শুরু করি। রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের ফলে বিশ্বে পারমাণবিক যুগে বেশ শক্ত অবস্থানে এলাম আমরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরাও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। সবকিছু ভালোভাবে পরিচালনা করতে আমরা তাদের রাশিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ এখন পরমাণু শক্তির অংশ হিসেবে আমরা একটি স্থান করে নিতে পারলাম এবং সেটি শান্তির জন্য। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
তিনি বলেন, পরমাণু শক্তি আমরা শান্তির জন্য ব্যবহার করব। অর্থাৎ এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উত্পন্ন হবে। সেই বিদ্যুৎ গ্রাম পর্যায়ে মানুষের কাছে যাবে। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি। মানুষের যত আর্থিক সচ্ছলতা আসবে এ চাহিদা বাড়তেই থাকবে।
তিনি বলেন, আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছি। এ অর্থনৈতিক অঞ্চল যত গড়ে উঠবে, সেখানে শিল্পায়ন হবে। যত বেশি শিল্পায়ন হবে, আমাদের বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাবে। সেটাকে মাথায় রেখেই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের পরিকল্পনাও আমরা নিয়েছি, সে বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সবার জন্য বিদ্যুৎ, এটা আমাদের সরবরাহ করতে হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, আজ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন। পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতির পিতা ও তার কন্যার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। রুশ পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণ বেশ জটিল একটি বিষয়। রুশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উত্কর্ষের প্রমাণ ভিভিইআর রিঅ্যাক্টর। যেটি রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণের পর এটি পরিচালনার জনশক্তিকেও প্রশিক্ষিত করে দেয়া হচ্ছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি ক্লিন এনার্জির একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। ফলে ২০ হাজার কর্মসংস্থান হবে। এটি শুধু স্থানীয় জীবনমানই পরিবর্তন করবে না, বরং জিডিপি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখবে। বাংলাদেশের পারমাণবিক প্রকল্প নির্মাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে রোসাটম। সময়মতো এটির নির্মাণ শেষ করতে রাশিয়া সম্ভাব্য সবকিছু করবে।
রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রকল্প পরিচালক ও পরমাণুবিজ্ঞানী ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, আইএইএর গাইডলাইন অনুযায়ী সব নির্দেশনা মেনেই রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিয়াউল হাসান।
১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এ প্রকল্পে নব্বই ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রুশ ঠিকাদার অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং একই পরিমাণ বিদ্যুৎ দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পাওয়া যাবে ২০২৪ সালে।