ভাওয়াল রিসোর্টের ভাঁজে ভাঁজে জমি হারানো মানুষের কান্না

গাজীপুর সদর উপজেলার মেম্বারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ইজ্জতপুর সড়ক ধরে চার কিলোমিটার ভেতরে ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’। সেখানকার নলজানী গ্রামে তিন দিকে বনভূমিবেষ্টিত এই রিসোর্ট এলাকার মানুষের কাছে ‘বেনজীরের রিসোর্ট’ নামে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, ১৬০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা ভাওয়াল রিসোর্টের ৩.৬৮ একর জমি বন বিভাগের। আর নিরীহ কৃষকদের অন্তত ৪০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন রিসোর্টটি।

ভাওয়াল রিসোর্টের ভাঁজে ভাঁজে জমি হারানো মানুষের কান্নাপরে মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করে কৃষকদের জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হয়। রিসোর্টটির ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে জমি হারানো মানুষের কান্না। জমির শোকে স্ট্রোক করে এ পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন মালিক। জোর করে লিখে নেওয়া জমি ফেরতের দাবিতে গতকাল শনিবার সকালে ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’র সামনে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি ভুক্তভোগী পরিবার।

মানববন্ধনে ব্যানার হাতে উপস্থিত ছিলেন নলজানী গ্রামের মো. শফিউল্লাহ। তিনি বলেন, “২০০৫-০৬ সালের দিকে নলজানী গ্রামে জমি কেনা শুরু করেন বেনজীর আহমেদ, আর ২০১১-১২ সালের দিকে শুরু করেন রিসোর্ট নির্মাণ। স্থানীয় জমির দালাল নলজানী মোজাদ্দেদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম মাস্টার, শিরিরচালা গ্রামের হাবিবুর রহমান ও বাংলাবাজার এলাকার নুরুর মাধ্যমে জমি কেনেন তিনি। আমার তিন নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা।

নলজানী সড়কের পাশেই বারুইপাড়া মৌজায় ২৫৩ ও ২৪৮ নম্বর দাগে নানাদের তিন বিঘা জমি ছিল। ২০১৩ সালের দিকে এক রাতে জমির কাঁচা ধান কেটে ফেলে দালালরা। পরদিন সকাল থেকে বালু ফেলে ভরাট শুরু করে। ওই সময় সেখানে পাহারায় অনেক পুলিশ সদস্য দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। রিসোর্টের ভেতরে আমার পরিবারের দুই একর (ছয় বিঘা) জমি ছিল।

ওই জমিও দখল করে নিয়েছে ভাওয়াল রিসোর্ট। বাধা দিতে গেলে রফিক মাস্টার ভয় দেখিয়ে বলে, ‘আমরা পুলিশের লোক। একটার পর একটা মামলা দেব। কয়টা সামলাইবা তোমরা?’ এ কারণে ভয়ে আর আমরা কাছে যাইনি। তার পরও চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ চারটি মামলা দেওয়া হয় আমার নামে। কাজ চলার সময় প্রায়ই বেনজীর আহমেদ এখানে আসতেন। তিনি আসার আগে পুরো এলাকায় পুলিশের পাহারা থাকত। ফলে জমি হারিয়েও বেনজীরের নাম শুনলে ভয়ে কেউ রিসোর্টমুখী হতো না।”

তিনি আরো বলেন, ‘রিসোর্টের প্রবেশমুখের এবং সামনের পতিত জমিটা আমার নানাদের। তিন নানার সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মধ্যে সবার বড় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সিরাজুল হক মুক্তিযুদ্ধকালে কাপাসিয়া উপজেলার কমান্ডার ছিলেন।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সিরাজুল হকের ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল হক মোবাইল ফোনে বলেন, ‘জমির শোকে আমাদের এক ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক মারা গেছেন। বড় ভাই এবং আমিও অসুস্থ। হুইলচেয়ারে চলাচল করি। জমি লিখে দিতে দালালরা অনেক চাপ দিয়েছে। দখল করে নিলেও আমরা জমি রেজিস্ট্রি করে দিইনি। নুরু ও রফিক মাস্টার প্রতি বিঘা জমি এক লাখ টাকা করে দিতে চেয়েছিল। অথচ ওই জমির দাম কোটি টাকার বেশি। জমি ফিরে পেতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’

ভাওয়াল রিসোর্টের নামে ১২ বিঘা জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন নলজানী গ্রামের সহজ-সরল কৃষক আমির উদ্দিন (৮৫)। তাঁর বাড়িতে গেলে আমির উদ্দিনের ছেলে মাহফুজুর রহমান হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, ‘ওই সময়কার বিভীষিকার কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আমার বাবা, ভাইদের নামে ধর্ষণ, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির আটটি মামলা দিয়ে কাউকে বাড়িছাড়া করে, আবার কাউকে জেলে পাঠায় পুলিশ। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে মাত্র ৫০ হাজার টাকা বিঘায় দালালদের কাছে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছি আমরা। দালালরা দলিল লিখে এনে পুলিশ প্রহরায় টিপ সই দিতে বাবাকে বাধ্য করে। কে কিনেছে, কতটুকু কিনেছে, কিছুই আমাদের জানায়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক হিসেবে আমাদের নাম ছিল। এই জমির ফসল দিয়ে পরিবারের বছরের খাবার জুটত। জমি লিখে নেওয়ার পর শোকে বাবা ২৬ দিন মুখে দানাপানি তোলেননি। জমির শোকে পর্যায়ক্রমে আমার মা নূরজাহান বেগম, বাবা আমির উদ্দিন ও ছোট ভাই শাহজাহান মারা গেছে। আমি এখন খাসজমিতে ঘর তুলে বাস করছি। জমির জন্য আমাদের পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের জমি ফেরত চাই। যারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চাই।’

জমি হারিয়ে বাকরুদ্ধ ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা ছাত্তার মুন্সি (৭৫)। তাঁর বাড়িতে গেলে ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘আমরা তিন ভাই ছয় বিঘা জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার আগে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনের চারটি মামলা দেওয়া হয় আমাদের নামে। ওই সময়টায় বহু রাত আমরা পালিয়ে বাঁশবাগানে কাটিয়েছি। জেল খেটেছি। ছয় বছর মামলা চালানোর পর অর্থসংকটে বাধ্য হই জমি লিখে দিতে। দালালরা বলেছিল, বিঘাপ্রতি এক লাখ টাকা করে ছয় লাখ টাকা দেবে। টিপ সই নেওয়ার পর দিয়েছে মাত্র তিন লাখ টাকা।’

ছাত্তার মুন্সির বড় ভাই আবদুল মজিদ বলেন, ‘প্রথমে জাল দলিল তৈরি করে জমির দালাল পুলিশ দিয়ে সবার জমি দখল করে নেয়। পরে মামলার ফাঁদে ফেলে কম দামে লিখে নেয়। এভাবে বহু মানুষ, বহু পরিবারকে নিঃস্ব করেছে ভাওয়াল রিসোর্ট।’

গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন আরেক কৃষক মনির উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘৬৭২ খতিয়ান ও ৩২০ দাগে আমাদের পৈতৃক তিন বিঘা এবং দুই বিঘা খাসজমি মিলিয়ে পাঁচ বিঘা জমি ছিল। আমার বাবা জমির দালাল হাবিবুর রহমানের কাছে পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করেন। কিছুদিন পর তিনি জমি চাষ করতে গেলে ভাওয়াল রিসোর্টের লোকজন বাধা দেয়। পরে জানতে পারেন, পুরো জমি হাবিবুর রহমান লিখে নিয়ে রিসোর্টের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।’

স্থানীয় লোকজন জানায়, বেনজীর আহমেদ র‌্যাবের প্রধান ও পুলিশ প্রধান থাকার সময় নলজানী গ্রামে ভাওয়াল রিসোর্টের জমি দখলের হোতা ছিলেন রফিক মাস্টার। জাল কাগজ তৈরি করে দখলে নিতেন জমি। পরে নামমাত্র দামে কিনে নিতেন। রফিক নলজানী মোজাদ্দেদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেও স্কুলে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকতেন। এখনো নিয়মিত স্কুলে যান না। বদলি লোক দিয়ে ক্লাস করান। নিজে জমির দালালি এবং জবরদখলে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর কথার বাইরে গেলে শুরু হয় একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার। এলাকার আতঙ্ক তিনি।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রফিক মাস্টার জবরদখলের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘বাঘের বাজার এলাকার বাদল ও হাবিবুর রহমান ভাওয়াল রিসোর্টের কাছে জমি বিক্রি করেছে। আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সত্য নয়। বেনজীর আহমেদ রিসোর্টের মালিক কি না, তা-ও আমি জানি না।’

ভাওয়াল মির্জাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দীর্ঘদিন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন মো. আবদুল মান্নান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বারুইপাড়া মৌজায় বেনজীর আহমেদের নামে জমি ছিল। তবে কত বিঘা জমি ছিল ভলিউম না দেখে বলা যাবে না। পরে তিনি ওই জমি ভাওয়াল রিসোর্টের কাছে হস্তান্তর করেছেন।’

এসব বিষয়ে ভাওয়াল রিসোর্টের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। নিরাপত্তা প্রহরী মো. মানিক বলেন, ‘স্যারেরা এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না।’

এন এস