সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার যিনি ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন। কঠিন সময়েও তার রহমতের দুয়ার আমাদের জন্য অবারিত রেখেছেন। আপনারা ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে আমাকে এ সংগঠনের আমীর নির্বাচিত করেছেন। দেশ ও জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর মতো আদর্শবাদী, নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও জনপ্রত্যাশিত একটি প্রগতিশীল দলের দায়িত্ব পালনে আমি আমার প্রিয় দেশবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা, আন্তরিক দোয়া এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার একান্ত সাহায্য ও রহমত কামনা করছি।
শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নব-নির্বাচিত আমীর ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন।
জামায়াতের নতুন আমীর বলেন, আজ আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি মকবুল আহমাদের প্রতি, যিনি এক কঠিন ক্রান্তিকালে আমীরে জামায়াত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আজীবন আমাদের হৃদয়ে অভিভাবক হিসেবে থাকবেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর নেক হায়াত দারাজ করুন এবং তাঁর সকল দ্বীনি খেদমত কবুল করুন।
আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সেই সমস্ত মহান ব্যক্তিদের যারা যুগে যুগে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ, মানবতার মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন দান করেছেন। বিজয়ের এই মাসে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শহীদ ও সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের বীরত্ব, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জন করেছি। শ্রদ্ধার সাথে বিশেষভাবে স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে।
তিনি বলেন, আমি আরো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, ভাষা সৈনিক ও ডাকসু’র সাবেক জিএস প্রফেসর গোলাম আযম, সাবেক আমীরে জামায়াত ও সাবেক মন্ত্রী শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলীকে যারা ইসলামের সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁদেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাদের শাহাদাত কবুল করুন। সেই সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা একেএম ইউসুফকে; যিনি দীর্ঘদিন সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারেই ইন্তিকাল করেছেন। আমি আরও স্মরণ করছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক একেএম নাজির আহমাদকে; যিনি দীর্ঘদিন সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেই সাথে গভীর মর্মবেদনা নিয়ে স্মরণ করছি জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সেই সমস্ত ভাই ও বোনদের যারা দ্বীন কায়েমের এই সংগ্রামে শাহাদাত বরণ করেছেন।
তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধার সাথে আরও স্মরণ করছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, পাঁচ বারের নির্বাচিত সাবেক এমপি মাওলানা আবদুস সুবহান, বিশ্ব বরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন, সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে যারা সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দীর্ঘ নয় বছর যাবত কারাগারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। জননন্দিত এই রাজনৈতিক নেতাদের সরকার যথাযথ চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত করেছে।
তিনি বলেন, সারা দেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্রীসংস্থাসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে মাসের পর মাস জেলখানায় আটকিয়ে রাখা হয়েছে। বহু সংখ্যক নেতা ও কর্মীকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শত শত নেতা-কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে অনেককে পঙ্গু করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আল আযামী, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ওয়ালিউল্লাহ, আল-মুকাদ্দাস, হাফেজ জাকির হোসেন, মুহাম্মাদ রেজওয়ান হোসেনসহ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। তাদেরকে পরিবারের কাছে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমি সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিরোধী দলের সকল নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি করছি।
তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু আজ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে কিছু নেই। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ নেই। মানুষের মৌলিক অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। মিছিল-সমাবেশসহ সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি কার্যত নিষিদ্ধ। বর্তমান সরকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন নজীরবিহীনভাবে একযোগে মহড়া দিয়ে মধ্য রাতের ভোট ডাকাতির মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে। যেহেতু ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে, তাই জনগণের প্রতি তারা কোনো দায়বদ্ধতার তোয়াক্কা করে না। দেশপ্রেমিক জনগণের নিকট এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত না থাকায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ জনজীবনকে অতীষ্ঠ করে তুলেছে। সরকারি ছাত্র সংগঠনের ছাত্র নামধারী ক্যাডাররা দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টর্চার সেল তৈরি করেছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী মত দমনে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। পিঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। অপরদিকে কৃষিপণ্য ও চামড়ার নায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক-জনতা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দলীয় লোকদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-আত্মসাৎ, মদ-জুয়া, ক্যাসিনো দেশকে গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ছে।
তিনি বলেন, দুনিয়ায় মানুষের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল বিচারাঙ্গণের অবস্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সরকার কর্তৃক একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার নজীরবিহীন ঘটনাই প্রমাণ করে বিচারাঙ্গণের চরম দুরবস্থার কথা। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনুপস্থিত।
সংস্কৃতির নামে বিদেশী অপসংস্কৃতিকে জোরপূর্বক জাতির ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। বর্তমানে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ সমস্যার আশু সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু ভারত অন্যায় ও অযৌক্তিভাবে সে দেশের লোকদের সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পুশ-ইন করছে। ফলে বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, প্রায় ৫ শত বছরের পুরোনো বাবরী মসজিদ সম্পর্কে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন তা ভারতের জনগণ ও মুসলিম উম্মাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা আশা করি ভারত সরকার বাবরী মসজিদটি পূর্বের স্থানে পুনরায় নির্মাণ করে সে দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় মৌলিক অধিকারের প্রতি সুবিচার করবেন। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান, চীনের উইঘুর মুসলমান, আফগানিস্তান, মিশর, ইরাক ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের উপর চরম জুলুম-নিপীড়ন চলছে। এ সব সমস্যার যথাযথ সমাধান খুঁজে বের করে নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলমানদের বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আশু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি ওআইসি, জাতিসংঘসহ সকল শান্তিকামী রাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সংগঠন পরিচালনা ও গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে আসছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করছে। আমরা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সন্ত্রাস ও চরমপন্থার ঘোরতর বিরোধী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও জামায়াত তার সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন, ত্যাগ-কুরবানীর বিনিময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শহীদদের চুড়ান্ত কুরবানী, জেল-জুলুম-নির্যাতন এ আন্দোলনকে মজবুত করেছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র পার্থিব সফলতা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিকট বিবেচ্য বিষয় নয়। পরকালের সফলতাই প্রকৃত সফলতা। আন্দোলনের সাফল্যের ব্যাপারে ধৈর্যের সাথে নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে অন্য কোনো পন্থায় যদি দেশ পরিচালিত হয় তাহলে স্বপ্নের বাংলাদেশ পাওয়া তো দূরের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। তাই ক্ষমতাসীনসহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতি আমার আহবান, আসুন দেশপ্রেম ও ইসলামী চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাই। বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে গিয়ে বুদ্ধিজীবী, আলেম-ওলামা, ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন।”