শ্লথ ব্যবসায়িক অগ্রগতি, প্রতিষ্ঠান জুড়ে ক্ষোভ
মাথাভারী প্রশাসনে নুয়ে পড়ছে প্রগতি লাইফ!

জিনান মাহমুদ:

গ্রুপ বীমা আর অর্ধবার্ষিক প্রিমিয়াম আয় কমছে প্রগতি লাইফের। লাগামহীন পদোন্নতি আর মাথাভারী প্রশাসনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রতিষ্ঠানটিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে চার কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়। এদেরকে কমিশন না দিয়ে- সরাসরি দেয়া হয় বেতনভাতা। তবে এতো সুযোগ সুবিধার পরও প্রতিষ্ঠানের কমছে ব্যবসা। এভাবে পদন্নতি আর বেতনভাতা- দেশের বীমা খাতে নজিরবিহীন। মাথাভারী প্রশাসন এখন গলার কাটা; এদের কারণে প্রগতি লাইফের ব্যবসায়ীক গতি আরো শ্লথ হয়ে পড়েছে- এমন অভিযোগ করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

প্রগতি লাইফের ২০২৪ সালের বার্ষিক হিসাব ও ২০২৫ অর্ধবার্ষিক হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম বর্ষ একক প্রিমিয়াম বৃদ্ধির হার ১.৭% অর্থাৎ ১৫৬ কোটি থেকে ১৮২ কোটি টাকা এবং জুন ২৫ পর্যন্ত অর্ধবার্ষিক প্রিমিয়াম কমেছে ৩.৫% অর্থাৎ ৬৮ কোটি থেকে ৬৬ কোটি টাকা- যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। একইসাথে গোষ্ঠী বীমার ক্ষেত্রেও প্রিমিয়াম কমেছে ২০২৪ সালে ৬% ও জুন’ ২৫ -এ ৩.৫%। এভাবে শ্লথ ব্যবসায় গতি নিয়ে হতাশ সংশ্লিষ্টরা। কেন ব্যবসা কমছে প্রগতি লাইফের- সেই প্রশ্ন তুলছেন। আর কারণ হিসেবে মাথাভারী প্রশাসনকে দায়ী করছেন তারা।

কোম্পানীর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, প্রগতি লাইফে চার এএমডির মধ্যে একক বীমা ব্যবসা উন্নয়নের দায়িত্বে রয়েছেন দু’জন, আর একজন গ্রুপ বীমার প্রধান এবং অপরজন প্রধান অর্থ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। কোম্পানীতে ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগ দেখছেন এএমডি ফারুক হোসেন ও জাহাঙ্গির হোসেন, গ্রুপ বীমার প্রধান হিসেবে রয়েছেন রফিকুল আলম ভূইয়া এছাড়াও এএমডি ও সিএফও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চন্দ্র শেখর দাস।

প্রগতি লাইফের ব্যবসা কমে যাওয়ায় বইছে চাঁপা ক্ষোভ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এএমডি হিসিবে পদোন্নতি প্রাপ্ত এসব কর্মকর্তাদের ব্যবসায়ী কার্যক্রম ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ প্রসঙ্গে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এতো সিনিয়র কর্মকর্তা থাকায় একদিকে যেমন ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে ব্যবসা। এভাবে ব্যবসা কম হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছেন মাথাভারী প্রশাসনিক সিস্টেমকে। তাদের মতে, চারজন এএমডি থাকার পরও কেন ব্যবসা কমছে- সেই উত্তর খুঁজতে হবে। দেশের অন্য কোন বীমা প্রতিষ্ঠানে বেতন ভিত্তিক একাধিক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার নজীর নেই। এতে অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাড়া বাবদ একদিকে প্রশাসনিক ব্যয় যেমন হু হু করে বেড়েছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্খিত ব্যবসা না হওয়ায়- অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রশাসনিক কাঠামোতে অস্থিরতা ও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, যা নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে প্রগতিকে। দ্রুত প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে- আগামীতে স্থবিরতায় ভুগতে হবে এই জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানকে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক প্রজেক্ট ডিরেক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এএমডিরা মাঠ পর্যায়ে সময় দেন না। সংগঠনগুলো ঠিকমত তত্ত্বাবধায়ন না করায় সারাদেশে প্রভাব পড়ছে, ব্যবসা কমছে। শুধু তাই না, এরা ব্যক্তি স্বার্থে জিএমদের সাথে আতাত করে পিডিদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে প্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। তাদের মতে, এ সকল এএমডিদের জন্য বেতন, অন্যান্য ভাতা, গাড়ী সুবিধা, সার্বক্ষণিক ব্যবসা উন্নয়ন মিটিংয়ে আপ্যায়ন এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক অফিসে যাতায়াতসহ বিভিন্নভাবে বছরে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বৃদ্ধি না হয়ে যদি ক্রমবর্ধমান কমতে থাকে- তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি পদের বিপরীতে চারজনকে পদায়নের ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে ব্যবস্থাপনা ব্যয়- অন্যদিকে সাধারণ গ্রাহক এবং শেয়ার হোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে করে গ্রাহকদের বোনাস কমার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) এ প্রভাব পড়বে। তাছাড়াও এএমডিদের ভিতরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাঠ। দেশের জীবন বীমা খাতে প্রগতি লাইফের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ব্যবসা উন্নয়নের জন্য আদৌ এসকল এএমডিদের প্রয়োজন আছে কিনা। বাংলাদেশের কোন বীমা কোম্পানী এমনকি ব্যাংকেও একাধিক এএমডি থাকার নজির নেই। আর এভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় প্রগতির বাকি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রতিষ্ঠান থেকে চিহ্নিতদেরকে বাদ দেয়া না হলে, বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সামনে আসতে শুরু করবেন।

এ বিষয় এএমডি ফারুক মাহমুদ অর্থবাংলাকে বলেন, দু’বছর আগে আমাদের তিনজনের পদোন্নতি হয়, আর আমাদের একবছর আগে পদোন্নতি হয় সিএফও চন্দ্র শেখর দাসের। কেন এই গণ-পদন্নতি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয় চেয়ারম্যান, এমডি ও পরিচালনা পর্ষদ জানেন- তারা আমাদের নিয়োগ দিয়েছেন। ব্যবসা কম হওয়ার উত্তরে ফারুক মাহমুদ বলেন, বছর শেষে কোম্পানীর ব্যবসা বেড়ে যায়, এতে করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ থাকে।

এছাড়াও এএমডি জাহাঙ্গির হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি মিটিং এ আছেন এবং সিএফও চন্দ্র শেখর দাস হাসপাতালে আছেন বলে জানান। অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম ভূইয়াকে ফোন করা হলে রিসিভ করেন নি।

এ প্রসঙ্গে কোম্পানীর সিইও জালাল উল আজীম বলেন, ‘‘যথাযথ নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে প্রগতি লাইফ, চাকুরীর ধারাবাহিকতায় পদোন্নতি পেয়ে উনারা এই পর্যায়ে এসেছেন।’’

এ ব্যাপারে কোম্পানীর চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি এবং এসএমএস করেও কোনো উত্তর মিলে নি।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এক কর্মকর্তা অর্থবাংলাকে বলেন, কোন প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত জনবল, নিয়মহীন পদোন্নতি কিংবা লাগামহীন বেতনভাতার সুযোগ নেই। তবে প্রগতির বিষয় নিয়ে তারা অবগত নন। যেহেতু এখন তাদের নজরে এসেছে- তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন।

সম্পর্কিত খবর