দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে ওষুধের দাম

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বৃদ্ধ সুফিয়া বেগম এক যুগের বেশি সময় ধরে ভুগছেন প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতে। সুফিয়া বেগমের ছেলের বউ জাহানারা বেগম গত রোববার জানান, তাঁর শাশুড়িকে চিকিৎসক ছয়টি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক বছর আগেও তিনি এসব ওষুধ কিনতেন সাড়ে তিন হাজার টাকায়। বর্তমানে পাঁচ হাজার টাকার বেশি লাগছে।

ঢাকার দোহার উপজেলার পুষ্পখালী গ্রামের মনির হোসেনের মা জুবেদা বেগম হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপসহ কয়েকটি রোগে ভুগছেন ১০ বছর ধরে। প্রতি মাসে তাঁর যেসব ওষুধ লাগে, সেগুলো কিনতে আগে দেড় হাজার টাকার মতো লাগত। মনির হোসেন জানান, বর্তমানে সেই ওষুধ কিনতে ব্যয় হচ্ছে দুই হাজার টাকা।

দেশে জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের দাম দফায় দফায় বাড়ছে; বিশেষ করে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের দাম বেশি বেড়েছে। কারণ, এসব ওষুধ রোগীদের নিয়মিত সেবন করতে হয়। সেই সুযোগে কোম্পানিগুলো ওই সব ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। গত দুই বছরে নানা অজুহাতে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পর আবার শুরু হয়েছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে ২০২২ সালে দুই দফায় প্যারাসিটামল, অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধসহ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধের দাম ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, গত বছরের মে মাসে দেশের শীর্ষস্থানীয় ছয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে এর কোনো প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেনি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির দাবি, ডলার-সংকটের কারণে ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য ডলার কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। ফলে তাদের ওষুধের দামও বাড়াতে হচ্ছে। গত মাসে কোনো কোনো ওষুধের দাম এক লাফে বেড়ে হয়েছে দেড় গুণ।

বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির ট্রেজারার ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিমুজ্জামান বলেন, ৮৪ থেকে ৮৫ টাকার ডলারের দাম বেড়ে এখন ১২৪ টাকা হয়েছে। জ্বালানি তেল ও অন্যান্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কাঁচামাল আমদানিতে অনেক ব্যয় বেড়েছে। এই অবস্থায় ছোট অনেক কোম্পানি টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওষুধের দাম যাতে সমন্বয় করা হয়, সে বিষয়ে সরকারের কাছে তাঁদের অনুরোধ রয়েছে।

একই সুরে কথা বলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসূফ। তিনি বলেন, কাঁচামালের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে; সেই সঙ্গে ডলারের দামও। এ কারণে ওষুধের দাম দেশে সমন্বয় করা হয়েছে। এটি করা না হলে অনেক কোম্পানি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দাম বাড়ানোটা একধরনের লুণ্ঠনমূলক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন হেলথ কনজ্যুমার রাইটস ফোরামের সদস্যসচিব জয়নুল সাঈদ রানা। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ এমনিতেই দিশেহারা। এর ওপর জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হলে মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, প্রথমে কোনো কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ালে কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্য কোম্পানিও দাম বাড়ায়।

জানা যায়, দেশে ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, বিক্রয়, বিতরণ, মজুত ও মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ড্রাগস অ্যাক্ট, ১৯৪০ এবং ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ একীভূত করে গত বছর একটি নতুন আইন পাস করা হয়। কিন্তু তাতে ১৯৯৪ সালের একটি আদেশ বহাল রাখা হয়েছে। ওই আদেশে বলা আছে, তালিকাভুক্ত ছাড়া অন্যান্য ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে নিজ নিজ কোম্পানি। সেই থেকে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনসিয়াল ড্রাগসের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারের বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এগুলোর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ২১৯টি থাকলেও মাত্র ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অথচ একসময় দুই শতাধিক ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার।

বাবুবাজারের মেসার্স আলিফ-লাম মিম মডেল ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি পলাশ কুমার দাস জানান, গত ২০ জানুয়ারি অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেড দাম বাড়ানোর জন্য ১২টি ওষুধের তালিকা দেয়। ২১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এভাবে অন্যান্য কোম্পানির ওষুধের দামও বাড়বে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধের একটি হলো অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডের অ্যাংকর প্লাস ট্যাবলেট (বিসোপ্রোলল ফিউমারেট ও হাইড্রোক্লোরোথায়াজিড)। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২.২৫ মিলিগ্রাম +৬.২৫ মিলিগ্রাম মাত্রার প্রতিটি বড়ির দাম গত ডিসেম্বরেও ছিল ৬ টাকা, বর্তমানে তা ৯ টাকা। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অ্যারিস্টোফার্মা ১২টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অ্যারিস্টোফার্মার হাইপারটেনশন রোগের আরেকটি বড়ির নাম ডুওব্লক ৫/৪০ মিলিগ্রাম। মাসখানেক আগেও প্রতিটি বড়ির দাম ছিল ১৯ টাকা। সেটি বাড়িয়ে ২১ টাকা করা হয়েছে। হৃদ্‌রোগ ও অ্যানজাইনা পেক্টোরিস বা করোনারি ধমনির জটিলতায় ব্যবহৃত নিট্রোকার্ড (২.৬ মিলিগ্রাম) বড়ির দাম ৫ টাকা থেকে করা হয়েছে ৭ টাকা। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত লিনাগ্লিপ এম (২.৫/৮৫০ মিলিগ্রাম) বড়ির দাম ১২ টাকা থেকে ১৬ টাকা, গ্লুভান প্লাস (৫০০ মিলিগ্রাম) ২১ টাকা থেকে ২৪ টাকা, ইম্পাগ্লিপ (১০ মিলিগ্রাম) ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা, ইম্পাগ্লিপ (২৫ মিলিগ্রাম) ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা এবং লিম্পা (৫/২০ মিলিগ্রাম) ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা করা করেছে।

এ বিষয়ে জানতে অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসানকে ফোন করা হলে সংযোগ কেটে দেন। পরে এসএমএস পাঠিয়েও জবাব মেলেনি।

ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘ওষুধের দাম সাধারণত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় না। কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দাম বাড়িয়ে থাকে, যা কোনোভাবেই উচিত নয়। কোম্পানিগুলো ইন্টারনাল কোনো আদেশের মাধ্যমে দামটা নির্ধারণ করে নেওয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। এটা একধরনের লুণ্ঠনমূলক প্রতিযোগিতা।’