সোনার বাংলা ইন্সুরেন্স
খালেক ও তার স্ত্রীর সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ!

অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল খালেক মিয়া ও তার স্ত্রী পারভীন আক্তারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
গত ২৫ জুন সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ. এস. এম. এম . কবির খান এই নোটিশ পাঠান। নোটিশে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসাতকৃত অর্থ কোম্পানির হিসাবে জমা দেয়ার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। অন্যথায় মামলা দায়েরসহ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে ইসলামি ইন্স্যুরেন্সের সিইও’র দায়িত্ব পালনরত বিতর্কিত এই বীমা কর্মকর্তা আব্দুল খালেক মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত হত্যা মামলারও আসামি। খালেক মিয়াকে পাঠানো আইনি নোটিশে বলা হয়, “আপনি গত ১৯/০৫/২০১৬ইং তারিখ থেকে ১২/০৭/২০২২ইং তারিখ পর্যন্ত সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এর মাদার কোম্পানি সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। উক্ত দায়িত্ব পালনকালীন সময় বিধি অনুযায়ী আপনি সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এর পরিচালক ছিলেন। এর প্রেক্ষিতে পর্ষদ কর্তৃক আপনাকে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্য সিগনেটরি মনোনীত করা হয়। উক্ত মনোনয়নের প্রেক্ষিতে আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাত করেছেন:
(০১) আপনার স্ত্রী মিসেস পারভীন আক্তার এর নামে কোম্পানিতে একটি বিও কোড ওপেন করেন, যার নম্বর ০০২৫। কিন্তু কোডে আপনি কোনো টাকা জমা না করে আপনার স্ত্রীর নামে ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ টাকার একটি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ০৭/০২/২০২২ইং তারিখে ইস্যু ও নগদায়ন করে তা আত্মসাত করেন।
(০২)আপনি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বিভিন্ন তারিখে আরও ৩,২২,৭৭,০০০/- (তিন কোটি বাইশ লক্ষ সাতাত্তর হাজার) টাকার ক্যাশ চেক ইস্যু করে তা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাত করেন।
(০৩) আপনি সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এর হিসাব বিভাগের সাবেক ডেপুটি ম্যানেজার জনাব মোঃ জহিরুল ইসলাম এর নামে ২৭/০৪/২০১১ইং তারিখে ০৪ (চার) লক্ষ টাকার চেক ইস্যু করেন। জনাব জহিরুল ইসলাম জানান যে, তিনি আপনার নির্দেশে টাকা তুলে আপনার নিকট হস্তান্তর করেছেন।
আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য কোম্পানি কর্তৃক আপনার নিকট২২/১২/২০২৪ইং, ০৫/০১/২০২৫ইং, ১৫/০১/২০২৫ইং এবং ২৮/০১/২০২৫ইং তারিখে পত্র প্রদান করা হলে, আপনি প্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করে ১২/০১/২০২৫ইং এবং ২১/০১/২০২৫ইং তারিখে কোম্পানি বরাবর দুটি পত্র প্রদান করেছেন বটে, কিন্তু তা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়নি।
এছাড়া, আপনার স্ত্রী মিসেস পারভীন আক্তারকে ০৯/১২/২০২৪ইং, ২২/১২/২০২৪ইং এবং ১৬/০১/২০২৫ইং তারিখে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য কোম্পানি থেকে পত্র প্রদান করা হলে তিনি এর কোনো জবাব প্রদান করেননি। জবাব প্রদান না করার প্রেক্ষিতে সর্বশেষ তাকে ০৩/০২/২০২৫ইং তারিখে আরও একটি পত্র প্রদান করা হলে, তিনি উক্ত পত্র গ্রহণ না করায় তা কোম্পানিতে ফেরত আসে।
এমতাবস্থায়, উপরোক্ত অভিযোগের বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কোম্পানি কর্তৃক গৃহীত না হওয়ায় এবং আপনার স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যা প্রদান না করায় আমার ক্লায়েন্ট সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নিকট এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, আপনি এবং আপনার স্ত্রী যোগসাজসের মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাত করেছেন।
অতএব, আত্মসাতকৃত মোট (৩০,০০,০০০/- + ৩,২২,৭৭,০০০/- + ৪,০০০০০/-) =৩,৫৬,৭৭,০০০/- (তিন কোটি ছাপান্ন লক্ষ সাতাত্তর হাজার) টাকা আগামী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে কোম্পানির হিসাবে জমা করার জন্য অত্র লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করা হলো। অন্যথায়, কোম্পানির পক্ষে আপনাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। উল্লেখ্য যে, ভবিষ্যতে এতদবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে অত্র লিগ্যাল নোটিশ (তারিখ ২৫/০৬/২০২৫ইং) এর কপি আমার চেম্বারে রাখা হলো।”
তবে সূত্র জানায়, আইনি নোটিশে বেঁধে দেয়া সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ওই অর্থ কোম্পানির হিসাবে জমা দেয়নি আব্দুল খালেক। ফলে তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে কোম্পানিটি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে সংঘটিত হত্যাকান্ডে ইন্ধন ও অর্থ যোগান দেয়ার অভিযোগে আব্দুল খালেক মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট হত্যাকান্ডে ইন্ধন ও অর্থ যোগানদাতা হিসেবে আরো দুটি অভিযোগ রয়েছে।
আব্দুল খালেক মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গাজীপুরে সংঘটিত হত্যাকান্ডের এক মামলার ৫৪ নং আসামি। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে দায়ের করা হত্যাকান্ডের দুটি অভিযোগের একটিতে ২৭ ও আরেকটিতে ৩৮ নং আসামি হিসেবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
খালেক মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গাজীপুরে সংঘটিত হত্যাকান্ডের একটি মামলার ৫৪ নং আসামি। গত ১১ অক্টোবর গাজীপুরের গাছা থানায় শহীদ রায়হান আলীর বাবা মামুন সরদার ওই মামলা দায়ের করেছেন। দন্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ৩০২, ১০৯, ও ৩৪ ধারায় দায়ের করা এই মামলায় আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন ও প্রতিহত করতে হত্যাযজ্ঞ চালাতে অর্থায়ন ও সার্বিক সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। আব্দুল খালেকসহ মামলার ১৬৭ জন আসামি সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, “আসামি ক্রমিক নং-২২ হতে ৬২ পর্যন্ত সকলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সিন্ডিকেট বাণিজ্য, ব্যাংকের তহবিল আত্মসাত ও নানাভাবে অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ-বিত্ত ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে এবং বিদেশে অর্থ পাচার করে। তারা অবৈধ সরকারের অবৈধ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যখন যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে অর্থ যোগান দিয়ে সর্বমহলে সরকারের অর্থ যোগানদাতা ও শেখ পরিবারের দুর্নীতির বিপুল পরিমাণের অর্থ পাচারে সহায়তাকারী হিসেবে পরিচিত। ”
“উল্লেখিত নং-২২ হতে ৬২ পর্যন্ত আসামিগণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য আসামি ক্রমিক নং-১ হতে ২১ এবং ৬৩ হতে ১৬৭ এদেরকে বিভিন্নভাবে নগদ অর্থ প্রদান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য সার্বিক সহায়তা করে। উক্ত আসামিগণ বিভিন্ন সময়ে গণভবন, সচিবালয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য বল প্রয়োগ পূর্বক গণহত্যা করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।”
এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে দায়ের করাহ ত্যাকান্ডের দুটি অভিযোগের একটিতে ২৭ ও আরেকটিতে ৩৮ নং আসামি হিসেবে খালেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
২৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে দায়ের করা হত্যাকান্ডের একটি অভিযোগে ৩৮ নং আসামি হিসেবে আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ২০ জুলাই যাত্রাবাড়িতে ছাত্রজনতার ওপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে শহীদ সোহেলের স্ত্রী আয়শা আকতার কুহেলি বাদী হয়ে এই অভিযোগ দায়ের করেছেন। এই অভিযোগে ২৭ নং আসামি হিসেবে ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধেও আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
ব্যাংক বীমা অর্থনীতি সূত্রে জানা যায়, গত ০৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে দায়ের করা হত্যাকান্ডের আরেকটি অভিযোগে ২৭ নং আসামি হিসেবে আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন করা হয়েছে। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়িতে শহীদ মিরাজ হোসেনের বাবা আঃ রব মিয়া এই অভিযোগ দায়ের করেছেন।