কোন পথে দেশের বীমা খাত ?

 

বীমা শিল্প বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে আজ শিরোনাম। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কৃপায় বীমা কোম্পানীর মালিক হয়েছেন। আসলে এদের অনেকেই সুবিধা ভোগ করতে এসেছেন। ব্যবসায়ীরা সর্বত্রই ব্যবসা খুঁজে তাদের কাছে নীতি নৈতিকতা মূল্যহীন। বীমা কোম্পানীর মালিকগণ যদি সত্যিকারভাবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হতেন তবে বীমা শিল্পের এই বেহাল দশা হতো না। শুধু মালিকগণই নয়। এই পেশার যথেচ্ছা ব্যবহারে ইডরাও পিছিয়ে নেই। ইডরা এখন জ্ঞান দন্ডহীন কাগুজে বাঘ। তর্জন গর্জন আছে কেবল তাদের জন্য যারা নীতি আদর্শ নিয়ে কাজ করেন, আর যারা অনিয়মের জন্ম দেন তাদের সাথে অহরম, দহরমে ব্যস্ত।

বীমা শিল্পের বিকাশে এখন ইডরাই বড় বাঁধা বা সমস্যা বলে একাধিক সিইও এবং খাত সংশ্লিষ্টরা এমনটি মনে করছেন। ইডরার অফিসে বর্তমানে প্রশাসনিক কোন শৃংখলা নেই। সদস্যদের বদলে নির্বাহীরা অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন। কোন কোন সদস্য আবার নিজেরাই বিতর্কিত। আর তাই নির্বাহীরা ইডরার চেয়ারম্যানকে নিয়ন্ত্রণ করেন। চেয়ারম্যান নিজের অযোগ্যতার কারণে নির্বাহীদের অসত্য ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বিতর্কিত হচ্ছেন। চেয়ারম্যান কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না, কারণ তার বীমা বিষয় জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার কথা ও কাজে মিল নেই। তিনি অবসরকারীন সময়ে যাদের কৃপায় ইডরার চেয়ারম্যান হয়েছেন, তাদের তুষ্ট করতে সত্যটাকে তলিয়ে না দেখে তাদের নির্দেশে কাজ করে বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। তাই তিনি তার নির্বাহী পরিচালকের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন। তারা লোভী, আর্থিক লেনদেনে অভ্যস্ত- এটা ওপেন সিক্রেট। তাই অসৎ, অনভিজ্ঞ সার্টিফিকেট জাল জুয়াচারী হতে শুরু করে, স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িতরাও অর্থের বিনিময়ে বীমা কোম্পানীর সিইও হিসাবে ইডরার অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছেন। ভুয়া ও জাল সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক বির্তকিত ব্যক্তি সিইওর দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান বীমা শিল্পকে জাহান্নামের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাচ্ছেন। তার অসৎ কর্মকর্তাদের বিতকির্ত কর্মকান্ড বীমা খাত কে ডুবিয়ে দিতে যথেষ্ট।

মালিক পক্ষগণ কোম্পানীর সিইওদের নিয়োগ দিয়ে ইডরার কাছে তা অনুমোদনের জন্য পাঠান। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইডরা তাদের অনুমোদন না দিয়ে ভাগড়া বসান, তার কারণ ঐ সকল সিইও ইডরার কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা দেন না বা তাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ প্রদান করেন না।

নতুন সিইওদের সার্টিফিকেট, ব্যাংক ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদির জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে কিন্তু তা কতটা? আমরা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে চলেছি তার জন্য কতটা সময় লাগতে পারে ১(এক) দিন বা ৭ (সাত) দিন বা ১৫ (পনেরো) দিনতো নয়ই তা হলে তা ইডরার অনুমোদন সময় মতো হয় না কেন?

ইডরা প্রতিনিয়ত সিইওদের নিয়োগ ও অপসারণ এবং ঘন ঘন চেক লিষ্ট পরিবর্তনে আগ্রহী হবার কারণ কি, তা এখন অনেকটা প্রকাশিত।
নিজেদের এবং বীমা মালিকদের সন্তানদের অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার একটা রাস্তা তৈরীর মতলব।

তবে, এর ফলে কি হতে পারে, তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। রূপালী জেনারেল, সোনালী লাইফ, গ্রীন ডেল্টা, ডেলটা লাইফ অদূর ভবিষ্যতে সোনার বাংলা ও ইউনিয়নের মতো আরো কারো নাম হয়তো প্রকাশিত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন মেনে ট্রাষ্ট ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, আনসার বিডিবি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক পরিচালিত হয়, কিন্তু দেশের সকল বীমা প্রতিষ্ঠানে বীমা আইন মেনে সিইওদের নিয়োগ দেয়া হয়? আইনতো সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।

জনাব বদরুল আমিন সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স ও জনাব মোঃ মোকলেছুর রহমান খান ইষ্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স এর সিইও ফাইল নিয়োগের অনুমোদনের জন্য ইডরায় পাঠানো হলে, দীর্ঘদিন পর তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় অনুমোদন দেয়া হয়নি, অথচ ইসলামী ইন্স্যুরেন্স এর বর্তমান সিইও ট্রিপল থার্ড ক্লাশ নিয়ে দিব্যি অনুমোদন পেয়েছেন- একেই বলে ইডরার আলাদীনের চেরাগ। আবার স্রেফ ইডরার চেয়ারম্যানের সাথে ‘ভালো সম্পর্ক’ এই বিশেষ যোগ্যতায় ইডরা থেকে সিইও হিসেবে স্বদেশ লাইফে জাহাঙ্গীর মোল্লার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। বড় অদ্ভুত লাগে কি করছে ইডরা! প্রগ্রেসিভ লাইফের জনাব জহির ইডরার লাইফ সদস্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে আজও কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জানা যায় নি।

এদিকে, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্বারা কোম্পানী পরিচালনা করতে ইডরা স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এই ভারপ্রাপ্তদের ও বীমা আইনে ৩ মাস ও সর্বোচ্চ ৬ মাসের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ডেল্টা লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ, আকিজ তাকাফুল লাইফ, সোনালী লাইফ (ইডরার চেয়ারম্যান ও বিআইএ-এর প্রেসিডেন্ট যার জন্য গর্ববোধ করতেন) মার্কেন্টাইল লাইফ, বেষ্ট লাইফ, বায়রা লাইফ, স্বদেশ লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, সেন্ট্রাল, ইষ্টার্ণ, ক্রিষ্টাল ও ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সও চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে।

যদিও ইসলামী কমার্শিয়াল দীর্ঘদিন হয় ইডরায় নতুন সিইও নিয়োগ অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে তারও কোন সুরাহা হয়নি। জানা গেছে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সিইও পবিত্র হজ্ব পালনে মক্কা গমন করবেন তার অবর্তমানে কিভাবে কোম্পানী চলবে?

অন্যদিকে অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞ ও পূর্বের দায়িত্ব পালনকারী অনেক সিইও বর্তমানে বেকার রয়েছেন, আবার ইডরা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বেকার রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোর্টের রায়কেও তোয়াক্কা করে না ইডরা। হোমল্যান্ড এর সিইওকে সরিয়ে শেয়ার কেলেংকারী পরিচালকদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে ইডরা, যারা ব্যাংকে রক্ষিত অন্যের শেয়ার নিজেদের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। সব সময়ই ইডরা চেয়ারম্যান সংবাদকর্মীদের বলে চলেছেন তিনি দেখবেন, তার জানা নেই ইত্যাদি। ৭১ টিভির সাংবাদিক প্রশ্ন করেছেন ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর সিইও’র সকল কাগজপত্র বৎসরখানেক আগে দেয়া সত্বেও কেন অনুমোদন দেয়া হয়নি? জবাবে চেয়ারম্যান মহোদয় বলেছেন তার জানা নেই তিনি বিষয়টি দেখবেন।

১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ এক চিঠির মাধ্যমে ইডরা থেকে জানানো হয় যে, “তদন্তে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও তথ্যের ঘাটতির কারণে” ইডরা তদন্ত টিম ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে পুন:তদন্ত করবে এবং ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত টিমকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় সীমা বেধে দেয়া হয়।

অথচ একদিন পর ১৩ই সেপ্টেম্বর ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর সম্মানিত চেয়ারম্যানকে, সিইও মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদকে অপসারণ করে নতুন সিইও নিয়োগের পরামর্শ দেন। তদন্ত কার্যক্রম শুরুর আগেই অপসারণ আইনে কি বলে? এমন অবস্থায় একজন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির কি করণীয়?

যারা এই অবস্থা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কাজ করছেন এবং নবায়নের জন্য তাদের কর্মক্ষেত্র চলমান তারা কাজ করতে করতে নবায়নের জন্য পাঠাবেন এইটাতো নিয়ম। এদের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন পর নানা অজুহাতে নবায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত করা হচ্ছে। ইডরার নবায়ন অনুমোদন না হওয়ার জন্য ঐ সকল সিইও বা কোম্পানী দায়ী নহে বরং ইডরার অব্যবস্থাপনা দায়ী। দীর্ঘদিন পর ইডরা কর্তৃক কোন সিইওকে নবায়ন না দিলে কোম্পানীর আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী কে হবে?

একজন সিইও’র অবর্তমানে কোম্পানীর সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। স্টেকহোল্ডারগণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মালিক ও কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্যে ভাটার সৃষ্টি করে। একজন সিইও-এর অবর্তমানে কোম্পানীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ব্যবসায় ধ্বস নামে এগুলো ইডরা কর্তৃপক্ষ কি বোঝেন না? তারা কেবল চলমান কোম্পানীকে অচল করার কাজে ব্যস্ত। বিভিন্ন উৎস থেকে অসত্য তথ্য নিয়ে কোম্পানীগুলোতে আতংক বিস্তারের জন্য ঘন ঘন তদন্ত টিম পাঠিয়ে নিজেদের বিতর্কিত করছেন। যদি কোন প্রমান পেয়ে থাকেন বা না পেয়ে থাকেন তবে তা কোম্পানীকে বা যার ব্যাপারে অভিযোগ তাকে তা জানাচ্ছেন না কেন? যে কেউ কোন ব্যাপারে অভিযোগ করলেই তা আমলে নিচ্ছেন কেন? অভিযোগকারীর নাম, ঠিকানা, মোবাইল ও ল্যান্ডফোন নাম্বার না থাকলে তার সত্যতা যাচাই করা যায় না তবুও কাউকে কাউকে হেনস্তা করার জন্য ইডরা তাই করছে। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল।

বিভিন্ন কোম্পানী থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চাকুরীচ্যুত কিছু বিপথগামী কর্মকর্তা বিভিন্ন জায়গায় কোম্পানী ও ব্যক্তির নামে কুৎসা রটনাসহ নানাবিধ কাজ ইডরার কিছু সংখ্যক অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজসে বেনামে চিঠি পত্রের মাধ্যমে বিভ্রান্তি করছে। আর ইডরা ঐ সকল বিপথগামী কর্মকর্তাদের সোর্স হিসাবে গণ্য করে বাছবিচার না করে বিভিন্ন বেআইনী পদক্ষেপে জড়িয়ে পড়ছে।

ইডরা ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কোন সিইও’র অনুমোদনের সময় কোম্পানী কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ভাতা কমিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় সিইওদের বেতন ভাতাদি ইডরা কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করেন। একজন সিইও একদিনে তৈরী হয় না। দীর্ঘদিন কাজ করার পর তার কর্মদক্ষতা, কঠোর পরিশ্রম, দক্ষ বীমা কর্মী নিয়োগ ও সংযোজন এবং কোম্পানীকে লাভবান করেই বেতন ভাতা নিয়ে থাকেন। ইডরার যদি স্বদিচ্ছা থাকে তবে প্রতিটি বীমা কোম্পানীর জন্য এক ও অভিন্ন বেতন স্ট্রাকচার তৈরী করে দেখাক। একজন সিইও’র উপর নির্ভর করে একটা কোম্পানী চলে তাই তাদের বেতন ভাতাদি নির্ধারণে মালিকদের ভূমিকাই মুখ্য। সিইও’র বেতন তার কর্মদক্ষতার যাচাই করেই মালিকপক্ষ ধার্য্য করেন। মালিক পক্ষ কি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অধিক বেতন দেয়ায় আগ্রহী হন? ইডরা যদি মনে করে তাঁরা বেতন কম পান বলে বীমা কোম্পানীর সিইওরাও কম বেতন পাবেন তাহলে তাদের সে মানসিকতার পরিবর্তন করা উচিত।

ইডরার প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই দেখা যায় অনেক কোম্পানীর সিইও ও মালিকপক্ষকে প্রতিনিয়ত আইনী লাড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে এবং অনেকেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে ইডরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে।

ইডরা গঠনের সময়ে প্রবীন বীমা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি “এডভাইজরী বোর্ড” গঠনের কথা ছিল। এতো দিনেও তা দেখা যায়নি। এখন এই দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে বীমা জ্ঞানে সমৃদ্ধ বীমা পেশাজীবিদের নিয়ে সত্ত্বর বীমা “এডভাইজারী বোর্ড” গঠন সময়ের দাবী। তাহলে ইডরার অনৈতিক ও আইন অমান্যকারী সিদ্ধান্ত থেকে বীমা শিল্প রক্ষা পাবে। ইডরাও নিয়ম বহির্ভূত কাজ থেকে বিরত থাকবে। আইনী লড়াইও বন্ধ হয়ে কোম্পানীগুলো সঠিকভাবে চলার প্রেরণা পাবে। ইডরার সৎ বুদ্ধি দেবার জন্য বীমা জানা যোগ্য লোকের সমাগম দরকার। বীমা শিল্প কোন ব্যক্তির সিদ্ধান্তে নয় বরং আইনের পরিপালন করে পরিচালিত হবে। এটাই সকলের প্রত্যাশা।

(লেখকঃ আশরাফুল চৌধুরী, অর্থবাংলা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে নেয়া)