বইয়ের নাম ‘বিমর্ষ বিকাল’

মনযূরুল হক:

 

মানুষের জীবনে পছন্দের কাজের চেয়ে অপছন্দের কাজ করতে হয় বেশি— এটা কোনও মহাকাব্যের বাণী হয়। নিছক একটা গল্পের লাইন। খুবই সাধারণ গল্প। একজন ইমাম, যিনি কবিতা পছন্দ করেন, একসময়ের ডাকসাইটে কবিকে জীবনযন্ত্রণায় ধুঁকতে দেখে কাতর হন—তার গল্প।

আমরা যখন কোনও সাড়াজাগানো মুভির আলাপ শুনি, ধরে নেই তাতে চরম ড্রামাটিক কিছু আছে; তারাশংকর কিংবা রবীঠাকুরের গল্প পড়তে পড়তে ভাবি, সেকালের কী দুর্দশা ছিল মাইরি; আর কবিতা হলে তো কথাই নেই, কী এক অদৃশ্য ভাবালুতায় দুলতে থাকি। যদি কেউ আপনার ছবি তুলতে চায়, ত্যাড়া-ব্যাকা হয়ে পোজ দিতে চান। এইসব কেনো? কারণ, মুভি, গল্প, কবিতা বা ছবিগুলোকে মনে হয় ভিন্ন একটা জগত—যা আমাদের জীবনে সচারচর ঘটে না। যা আমরা করি, খাই, ঘুমাই—তা আবার গল্প, চরিত্র বা পঙ্ক্তি হয় কী করে? আমি তো কোনও নায়ক নই, কোনও মহামানব নই।

কিন্তু লেখক শামীম আহমেদ এক আশ্চর্য কাজ করেছেন। তিনি একটা সাধারণ আটপৌরে জীবনকে ভেঙে একেবারে খণ্ড বিখণ্ড করে একটা একটা টুকরো তুলে দেখিয়েছেন জীবন কেমন গল্পময়। পড়ি আর পড়ি। ক্রমশ দ্রবীভূত হই, মুগ্ধ হই, হই বিস্মিত—আমিও তাহলে গল্পের উপাদান হতে পারি। আমার জীবনেও তো তাহলে কত অজস্র গল্প আছে। যে-গল্পগুলো বন্ধুদের চায়ের আড্ডায় কতবার কত দুঃখিয়ে-রসিয়ে বলেছি।

শামীম ভাই, সেই আমাদের আনতারার আড্ডার সাথি। কতদিন পরে দেখা। এতদিনে এত বড় গল্পকার হয়ে গেছেন খোঁজ রাখি নি। প্রথাগত যশে বেষ্টিত হন নি বটে, আর এই অধমেরও কন্টেম্পরারি বই-পুস্তক তেমন ধরা হয় না, কিন্তু তিনি যা লেখেন, লিখেছেন, লিখে চলেছেন, তা ব্যাখ্যাতীত—চলতি লেখকদের তা লেখার সাধ্য নেই।

‘বিমর্ষ বিকাল’ বইটা হাতে পেয়ে বাসায় যেতে যেতে গাড়ির সিটে উবু হয়ে পড়ে ফেলেছি আধেকটা। পাবলিক বাসের কোলাহলে সব বই পড়তে নেই। যদি আপনার চোখ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে বা কান্নায় ভারী হয় বুক—লোকে কী বলবে। কিন্তু আমি ছাড়তে পারি নি। আয়েশাকে গিয়ে বললাম : এই বইটা প’ড়ো। কিন্তু সকালে আবার অফিসে আসার পথে হাতে করে নিয়ে নিলাম। পড়তে পড়তেই বুঝলাম— এ-বইয়ের নাম ‘বিমর্ষ বিকাল’ কেনো। কোনও এক মেঘলা বিকালে, যখন সারা পৃথিবীর কষ্ট এসে ভর করবে আপনার হৃদয়ের দলিজায়, তখন এই বইটা আপনি পড়বেন। না, আপনার মন ভালো করবে না সে—কেননা, মোটিভেশন তো মোটেই এতে নেই—আপনি শুধু আপনার নিজেতে, জীবনের ভেতর-বাহিরে, চিরসবুজ স্মৃতির কাহনে আন্দোলিত হবেন। সন্ধ্যার আরক্তিম আলোতে আপনার ললাট ফুলে ফুলে উঠবে। একটা কলম যদি আপনি না-ও পান তখন, শুধু ইটখড়ি দিয়ে দেয়ালজুড়ে লিখতে থাকবেন আপনার নিজের গল্প। একদিন তা-ও প্রকাশিত হবে। বায়তুল মোকাররমের জনাকীর্ণ সমাবেশে সে-গল্পের উদ্বোধন না-হোক, অধমের মতো দু-দশ ডজন স্রোতহারা বখে যাওয়া পাঠক আপনি পেয়ে যাবেন—নিশ্চিত।

শামীম ভাইকে ধন্যবাদ। আমি তার বই পড়তে চাই। অফিস-বাসার মধ্যিখানের ভিড়চাপা যাত্রায় তার বইয়ের হালকা-নরম মলাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই। একটা জীবন এভাবে ঝুলতে ঝুলতে কাটিয়ে ধন্য হতে চাই।