আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স
সনদ জালিয়াতি: সিইও হওয়ার সুযোগ নেই আলমগীর চৌধুরীর

আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক এডিশনাল এমডি আলমগীর চৌধুরীর ‘সিইও’ হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে শিক্ষা সনদ সংগ্রহের প্রমাণ মেলায়, আকিজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিইও আলমগীর চৌধুরীর পুনঃবিবেচনার আবেদন না- মঞ্জুর করে কর্তৃপক্ষ। গত ১৯ আগস্ট আইডিআরএর পরিচালক (উপসচিব) মোহাঃ আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে শিক্ষা সনদ ও অন্যান্য বিষয়ে ১৫ টি অসঙ্গতি চিহ্নিত করে এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করে।
চিঠিতে আইডিআরএ জানায়, আকিজ তাকাফুল লাইফের পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির সিইও হিসেবে আলমগীর চৌধুরীর নিয়োগ অনুমোদনের আবেদন করে। কোম্পানির দাখিল করা তথ্য পর্যালোচনা করলে বেশ কিছু অসঙ্গতি উঠে আসে।
আলমগীর চৌধুরীকে দেয়া আইডিআরএর চিঠিতে বলা হয়-
১। আপনি (আলমগীর চৌধুরী) দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা হতে স্প্রিং ২০০০ থেকে উইন্টার ২০০৩ শিক্ষাবর্ষে পূর্ণকালীন ছাত্র হিসেবে বিবিএ (BBA) ও স্প্রিং ২০০৪ থেকে উইন্টার ২০০৪ শিক্ষাবর্ষে এমবিএ (MBA) ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
২। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), দি ইউনিভাসিটি অব কুমিল্লা এর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং চলমান মামলা, বিওটি গঠন সংক্রান্ত বিভ্রান্তি, সনদ বাণিজ্য, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় কমিশন থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরুর অনুমতি প্রদান করা হয়নি।
৩। যেহেতু, বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় (২৩ মে ২০১৮ খ্রি-বিডিনিউজ২৪.কম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ খ্রি:- দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৪ঠা এপ্রিল, ২০২৪ দি-ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও প্রথম আলো English) প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মজুরী কমিশন কর্তৃক ছাত্র-ছাত্রীদের সতর্ক করে দি ইউনিভাসিটি অব কুমিল্লা তে ভর্তি না হওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
৪। যেহেতু আপনাকে আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন প্রস্তাব দাখিলের তৎপরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, আপনি জাল/ভুয়া সনদের মাধ্যমে আকিজ তাকাফুল পিএলসি এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদের জন্য কোম্পানীর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ বরাবর আবদেন করেছেন। এসকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষ আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের যথার্থতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
৫। যেহেতু, বিশ্ববিদ্যালয় নজুরী কমিশন (ইউজিসি) কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত সনদের যথার্থতা যাচাই করে না এবং সনদ ইস্যুকৃত বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপক্ষ সমর্থন করে থাকে, তাই তদন্তক্রমে বিডির পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়।
৬। যেহেতু, আপনি, গত ১লা ডিসেম্বর ১৯৯৬ খ্রি. থেকে জুন ২০০০ খ্রি. পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ২০০১-২০০৩ সময়ে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর জয়েন্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ডেভ) হিসেবে পূর্ণকালীন কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও আপনি, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে সিনিয়র প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে ২য় দফায় ০২/০৫/২০০৬ খ্রি থেকে ০১/০৪/২০১১ খ্রি. পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। উক্ত কোম্পানি সমূহে চাকরিকালে আপনি উচ্চ শিক্ষা (বিবিএ, সেশন- স্প্রিং। ২০০০- উইন্টার ২০০৩ ও এমবিএ, সেশন- স্প্রিং ২০০৪- উইন্টার ২০০৪ ডিগ্রি) গ্রহণের বিষয়ে কোম্পানীর কোনো অনুমতি গ্রহণ করেননি। সাধারণত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্প্রিং সেশন শুরু হয় জানুয়ারিতে আর আপনি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স এ জুন ২০০০ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কোন কোম্পানীকে অবহিতও করেননি।
৭। যেহেতু, আপনি ২০/০২/২০১১ খ্রি তারিখে সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে এসএডি পদে পূর্ণকালীন হিসেবে যোগদান করেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা বি. কম (পাশ) উল্লেখ করে প্রমাণক দাখিল করেন। আপনার বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি দাবী করেননি।
৮। যেহেতু, আপনি, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ খ্রিঃ তারিখে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর এএমডি হিসেবে যোগদান করেছেন এবং আগস্ট ২০১৮ খ্রি. পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। উক্ত কোম্পানিতে আবেদনকালে আপনি ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক পাশের তথ্য দাখিল করেছেন। কিন্তু ২০০৩ সালের অর্জিত বিবিএ ডিগ্রি ও ২০০৪ সালে অর্জিত এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এছাড়া ট্রাস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এ চাকরীবাদে আপনি বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি কোম্পানী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি।
৯। যেহেতু আপনি, স্বদেশ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এর সিনিয়র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছেন ১লা অক্টোবর ২০২০ খ্রিঃ তারিখে। উক্ত কোম্পানীতে আবেদনকালেও আপনি ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্জিত স্নাতক (বি.কম.) পাশের তথ্য দাখিল করেছেন কিন্তু ২০০৩ সালের অর্জিত বিবিএ ডিগ্রি ও ২০০৪ সালে অর্জিত এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এমনকি ২৭ জুন ২০২১ খ্রি পর্যন্ত উক্ত কোম্পানিতে চাকরিকালে আপনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে আপনার উচ্চ শিক্ষা অর্জনের বিষয়টি অবহিত করেননি।
১০। যেহেতু, কর্তৃপক্ষে দাখিলকৃত আপনার আবেদনে এমবিএ ডিগ্রির সিজিপিএ উল্লেখ করেছেন ৩.৭০ কিন্তু দাখিলকৃত প্রডিশনাল সনদে সিজিপিএ রয়েছে ৩.৮০। কোম্পানীর আবেদনের প্রেক্ষিতে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কর্তৃক পত্রে এমবিএ ডিগ্রিতে সিজিপিএ উল্লেখ রয়েছে ৩.৫০ যাহা সন্দেহ উদ্রেককারী।
১১। যেহেতু, আপনি দাবি করেছেন ২০০০ সালের স্প্রিং সেশন থেকে ২০০৩ সালের উইন্টার সেশনে বিবিএ এবং ২০০৪ সালের স্প্রিং সেশন থেকে ২০০৪ সালের উইন্টার সেশনে পূর্ণকালীন ছাত্র হিসেবে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং একই সময়ে অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৯৯৬ খ্রিঃ থেকে জুন ২০০০ খ্রি. পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মে ২০০১ খ্রিঃ থেকে ৫০ জুলাই ২০০০ খ্রি. পর্যন্ত প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জয়েন্ট এগ্লিফিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাবর্ক্ষণিক প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময়ে দুইটি সাবর্ক্ষণিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা বাস্তবসম্মত নয় ও সন্দেহজনক।
১২। যেহেতু, আপনি পূবর্তন সকল কর্মস্থলে স্নাতক পাশের প্রমান দাখিল করেছেন কিন্তু বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের সনদ বা তথ্য দাখিল করেননি। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ লাভের জন্য আপনি ডিগ্রি অর্জনের সুদীর্ঘকাল পরে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রির দাবী করেন। উক্ত বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের বিষয়ে পূর্বতন কর্মস্থলসমূহের কর্তৃপক্ষকে অবগত করার এবং অনুমতি গ্রহণ করার কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি এবং আপনায় এমবিএ ডিগ্রির ফলাফলেও অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান রয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আপনি শঠতা বা জালিয়াতির মাধ্যমে উল্লেখিত সনদসমূহ অর্জন করেছেন।
১৩। যেহেতু, ইতোমধ্যে আপনি আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের অনুমোদন প্রস্তাব না-মন্জুর বিষয়ে একই আইনজীবীর মাধ্যমে যুগপৎভাবে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে ০২ (দুই) টি মীট মামলা যথা- রীট পিটিশন নং ১১৪৩/২০২৫ ও রীট পিটিশন নং ৫২৯/২০২৫ পরিচালনা করেছেন যা আইনবহির্ভুতভাবে সুবিধা লাভের প্রচেষ্টা এবং নৈতিকভাবে সমীচীন নয়। যদিও পরবর্তীতে রীট পিটিশন নং ১১৪৩/২০২৫ মামলাটি ডিসচার্জ ফর নন প্রসিকিউশন হিসেবে প্রত্যাহার হয়েছে এবং ৫২৯/২০২৫ রীট মামলাটি Not Present Rejected হয়।
১৪। যেহেতু, আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি থেকে আপনি ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন এবং কোম্পানি আপনার বদলে অপর একজনের নামে নিয়োগ প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ বরাবরে দাখিল করেছে।
১৫। সেহেতু, আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স পিএলসি এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের অনুমোদন প্রস্তাব না-মঞ্জুর বিষয়ে আপনার গত ২৮/০৪/২০২৫ খ্রি. তারিখের রিভিউ আবেদনটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পুন:বিবেচনান্তে না-মঞ্জুর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীকে সিইও পদে নিয়োগ অনুমোদন দিতে আইডিআরএর কাছে আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দীন। সনদ জালিয়াতির কারণে তার নিয়োগ অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আইডিআরএ। ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল সনদের সঠিকতা দাবী করে ‘সিদ্ধান্ত’ পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করেন আলমগীর চৌধুরী। যার ধারাবাহিকতায় সবশেষ অনুমোদন প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে ১৯ আগস্ট আইডিআরএ থেকে চিঠি দেয়া হয়।