শুধু জরিমানা করে নকল ওষুধের আগ্রাসন বন্ধ করা যাবে না

মুনীর উদ্দিন আহমদ:

গত ২১ নভেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মিটফোর্ডে নকল ওষুধ বিক্রির একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে। প্রতিবেদনে জানা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালত নকল ও বিক্রয় নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির দায়ে রাজধানীর বাবুবাজারে ৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা ছাড়াও ৪৬টি দোকানকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। বাজেয়াপ্ত ওষুধের মধ্যে পশু মোটাতাজাকরণের ডেক্সামেথাসন ছাড়াও অন্যান্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও রয়েছে। সমসাময়িককালে র‌্যাব ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের যৌথ অভিযানে মিটফোর্ডে বিদেশি ওষুধের মোড়কে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির দায়ে ৬টি দোকানকে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অসংখ্যবার নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হলেও থামছে না এ দুর্নীতিবাজ দুষ্টচক্রের অনৈতিক ও আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড। অভিযানের পর ট্রাকভর্তি নকল, ভেজাল ওষুধ ও বিপুল পরিমাণ নকল চিকিৎসা উপকরণ সরিয়ে নিতে দেখলাম।

মজার ব্যাপার হল, র‌্যাব ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের যৌথ অভিযানের খবর শুনে আগেভাগে বহু দোকান বন্ধ করে লোকজন পালিয়ে যায়। প্রশ্ন হল, অভিযানের খবর এরা পেল কীভাবে? দ্বিতীয়ত, দোকানভর্তি নকল ওষুধ রাখা ও বিক্রির দায়ে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হল এসব মানুষ হত্যাকারী দুষ্কৃতকারীকে; এটা কি সঠিক বিচার হল? এরা কি পরবর্তী সময়ে আবার একই কাজে লিপ্ত হবে না! কী হবে এ দেশের অসহায়-নিরীহ মানুষের! এভাবে চলতে থাকলে কীভাবে বাঁচবে এরা হাজারও প্রাণঘাতী রোগ থেকে! আমি খুব অসহায়বোধ করছি এবং এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

কিছুদিন আগে র‌্যাবের এক ভ্রাম্যমাণ আদালত হাতিরপুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি টাকা মূল্যের নকল ও ভেজাল ওষুধ আটক করেছে। সিলভান ট্রেডিং কোম্পানির মালিক জাহাঙ্গীর আলমকে এ দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার এক কর্মচারীকে দেয়া হয়েছে ছয় মাসের জেল। একই এলাকায় টোটাল ফার্মা নামের আরেক কোম্পানিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, দুষ্কৃতকারীরা মিটফোর্ড থেকে নিম্নমানের ওষুধ কিনে এনে বিদেশি ওষুধ কোম্পানির লেবেল লাগিয়ে চড়া দামে বাজারে বিক্রি করত। কিছু দুর্নীতিবাজ চিকিৎসক টাকার বিনিময়ে এসব দুষ্কৃতকারীকে সাহায্য করত বলে তাদের নকল-ভেজাল ওষুধ বিক্রিতে কোনো অসুবিধে হতো না। মাসখানেক আগে আরেকটি অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত দেশের অতি পরিচিত বৃহত্তম ড্রাগ স্টোর লাজ ফার্মাসহ আরও দুটি ওষুধের দোকানের মালিককে সাড়ে সাত লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এ ওষুধের দোকানগুলোতে কিডনি, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের অবৈধভাবে আমদানি করা ওষুধ পাওয়া যায়। ওষুধগুলোর গুণগত মানের নিশ্চয়তা ছিল না।

এখানেই শেষ নয়; নকল-ভেজাল ওষুধ নিয়ে এ দেশে আরও বহু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে নীরবে-নিভৃতে। দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে আমাদের এ বাংলাদেশ; না হলে কেবলমাত্র মুনাফার লোভে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও মরণাপন্ন রোগীকে জিম্মি করে এ ধরনের অমানবিক খেলা কীভাবে খেলতে পারে এসব দুষ্কৃতকারী! পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে সম্ভব না হলেও এ দেশে এখন দেখছি সবই সম্ভব। আমরা জানি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের গায়ে নতুন করে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বসিয়ে বাজারে ছাড়া হচ্ছে অসংখ্য ওষুধ। একই দিন মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বসানোর জাল মেশিনসহ এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল দিয়েও তৈরি হচ্ছে নানা পদের ওষুধ। আশপাশের দেশ থেকে কয়েক মাস মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকা ওষুধের কাঁচামাল সস্তায় আমদানি করে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সেই কাঁচামাল ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদন করে দীর্ঘসময় মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বসিয়ে বিপণন করছে ওই ওষুধ। জানা যায়, দেশে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এগুলো দেশের বাজারে বিক্রি করে একদিকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ভরছে, অন্যদিকে অবৈধ পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করা হচ্ছে বিদেশে। এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট শুল্ক শাখার কর্মকর্তাদের অতীতে এ ধরনের অবৈধ পণ্যের বহু চালান জব্দ করার ঘটনা আমরা পত্র-পত্রিকায় অনেক পড়েছি।

এনবিআর সূত্রে বলা হয়েছিল, একবার জব্দ করা ১৯টি চালানের পণ্য আমদানির দাম হিসেবে ৪২ কোটি ৩৬ লাখ ১২ হাজার টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। অথচ বাজারমূল্য যাচাই করে এনবিআর নিশ্চিত হয়েছিল, মানসম্মত ও ব্যবহার উপযোগী একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হলেও ৩ কোটি টাকার বেশি পরিশোধের প্রয়োজন হতো না। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ধরনের অবৈধ পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করছে। শুধু এনবিআরই নয়, সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর প্রতিবছর অভিযান চালিয়ে এ ধরনের অবৈধ ওষুধ ও চিকিৎসামগ্রী উদ্ধার করে থাকে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও মানহীন চিকিৎসা সরঞ্জাম সবচেয়ে বেশি আনা হচ্ছে চীন, কোরিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান থেকে। বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রির তথ্য পাওয়া গেলে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আমদানি বন্ধে নজরদারি বাড়ানো হয় কখনও কখনও। কিন্তু সেই নজরদারি বেশিদিন টেকে না, শিথিল হয়ে পড়ে কোনো এক সময়; যা এ দেশের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সামান্য ব্যথা-বেদনা বা জ্বর সারানোর জন্য নকল প্যারাসিটামল ব্যবহারে রোগ না সারলেও তা আপনার জীবনের জন্য বিপজ্জনক না-ও হতে পারে; যদিও তা অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে; কিন্তু এমন সব রোগ আছে যে ক্ষেত্রে ওষুধ সঠিক মাত্রায় সেবন না করলে রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে এবং একসময় রোগী মারাও যেতে পারে। সংক্রামক রোগের প্রতিকারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার অপরিহার্য। জীবাণু দ্বারা শরীর বা শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও জীবাণুর মধ্যে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শরীর তার প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা বা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে যায়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করা হলে জীবাণু শরীর ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করে।

এর ফলাফল একটাই- স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং পরবর্তী সময়ে অবধারিত মৃত্যু। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে কার্যকারিতা না পেয়ে চিকিৎসক বা রোগী একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে থাকে। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে জীবাণু ওষুধের কার্যকারিতাকে নিষ্ফল করে দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে শরীরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বর্তমান বিশ্বের ভয়ানক বিপদগুলোর মধ্যে অন্যতম বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্প্রতি ল্যানসেট প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপকে ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ উচ্চরক্তচাপে মৃত্যুবরণ করে। উচ্চরক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটো প্রাণঘাতী রোগ হল হৃদরোগ ও স্ট্রোক। হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ অকর্মণ্য হয়ে যায় বা মৃত্যুবরণ করে। প্রাকৃতিক উপায়ে অথবা লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে রোগীকে ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। ওষুধ যদি আসল ও গুণগতমান সম্পন্ন হয়; তবে রোগী ওষুধ সেবন করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। আর ওষুধ যদি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের হয়; তবে রোগীর কী অবস্থা হবে, একবার ভেবে দেখুন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সারা বিশ্বে বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোয় অসংখ্য রক্তচাপের ওষুধ নকল হচ্ছে এবং এসব ওষুধ সেবন করে অগণিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও জীবন দিচ্ছে। ক্যান্সার প্রাণঘাতী রোগ।

এ রোগ প্রতিকারে এখনও খুব বেশি কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আর যেসব ওষুধ বাজারে প্রচলিত আছে, সেগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অ্যাভাস্টিন একটি বহুল প্রচলিত ক্যান্সারের ওষুধ। অ্যাভাস্টিনের একটি মাত্র ভায়ালের দাম আড়াই হাজার ডলার (২ লাখ ৫ হাজার টাকা)। প্রতিবছর এ ওষুধের মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার। অসাধু নকলবাজ ব্যবসায়ীরা অ্যাভাস্টিনের নকল ভার্সন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের লাভজনক ব্যবসাটি হাতিয়ে নিয়েছে। নকল অ্যাভাস্টিন এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে; যার কারণে ক্যান্সারের রোগীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা সেসব ওষুধ বেশি নকল করে, যেগুলো বিক্রির দিক থেকে শীর্ষস্থানীয়। ফাইজারের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ লিপিটর (জেনেরিক : অ্যাটরভেস্টাটিন) বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্লকবাস্টার ওষুধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও লিপিটরের নকল পাওয়া যায়। ২০০৭-০৮ সালে নকল হেপারিনের (যে ওষুধ রক্তজমাট প্রতিহত করে) ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৯ জন লোক মৃত্যুবরণ করে। এ নকল হেপারিন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল।

সারা বিশ্বে নকল ওষুধ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হল- পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, ল্যাটিন আমেরিকা, পূর্ব মধ্য ইউরোপের অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হয়; যেসব দেশে ওষুধ শিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ এসব দেশে ওষুধ ও ওষুধ শিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও নকলের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ওষুধের অনলাইন বেচাকেনা বিশ্বজুড়ে নকল ওষুধের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করেছে। এসব ফার্মেসির অনেকগুলোই বিদেশি বলে এদের ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা অবৈধ। অনেক ওষুধের জন্য আবার প্রেসক্রিপশন লাগে না। এ সুযোগে অসংখ্য নকল ও ভেজাল ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে যায়।

নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধ এত সহজ নয়, বিশেষ করে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে। কারণ এসব দেশে শ্রেণিবৈষম্য ও মাথাপিছু আয় নগণ্য হওয়ার কারণে দামি ওষুধ কেনার সামর্থ্য না থাকায় গরিব মানুষ সস্তায় ওষুধ পেতে চায়। ওষুধের দাম বেশি হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয়ে বেশি উৎসাহী হয়। এ ফর্মুলা ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বাড়ায়। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অসংখ্য ওষুধের দাম দুই থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সুযোগটা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। মিটফোর্ডের অবৈধ মার্কেটে কাঁচামালের জোগান দেয় দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি। ওষুধ উৎপাদনের নাম করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল কিনে নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রি হলেও রহস্যজনক কারণে তারা এ অবৈধ বেচাকেনা বন্ধ করে না।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের ফলে আজকাল আসল আর নকল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শুধু জানা যায়, কোনটা আসল আর কোনটা নকল ওষুধ। তারপরও কিছু চিহ্ন আর বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নকল ওষুধ চেনা যায়। নকল ওষুধের অদ্ভুত ধরনের গন্ধ, স্বাদ ও রং থাকে। নকল ওষুধ অতিসহজে ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যায় বা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ওষুধের প্যাকেটের গুণগতমান তেমন ভালো হয় না। লেবেলে নির্দেশনায় ভুল বানানের শব্দ থাকে এবং নির্দেশনায়ও ভুল থাকতে পারে। নকল ওষুধের দাম অত্যন্ত কম হয়। আসল ওষুধের দামের সঙ্গে তুলনা করলে একই নকল ওষুধের দামের তারতম্য ওষুধের গুণগতমান সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। নকল ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কিছু উপায় আছে। উপায়গুলো অবলম্বন করলে নকল ও ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে।

এক. আপনার পরিচিত দোকান থেকে ওষুধ কিনুন, যে দোকান বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত। গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ওষুধ কিনুন। দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো তুলনামূলকভাবে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করে। অজানা-অচেনা লাইসেন্সবিহীন কোনো কোম্পানির ওষুধ কিনবেন না।

দুই. ওষুধ কেনার পর ওষুধের প্যাকেট ভালো করে পরীক্ষা করুন। নকল ওষুধ হলে প্যাকেটে কোনো না কোনো ভুল বা ত্রুটি ধরা পড়বে। প্যাকেটের ভেতর যে লিফলেট রয়েছে তা-ও ভালো করে পড়ে দেখুন। সেখানেও অসংখ্য ভুল থাকতে পারে। ওষুধটি ভালো করে পরীক্ষা করুন। আসল ও নকল ওষুধের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। সন্দেহ হলে ওই দোকান থেকে ওষুধ কিনবেন না।

তিন. বিদেশ ভ্রমণকালে আপনার সব ওষুধ সঙ্গে নিন। পথে-ঘাটে ওষুধ কিনবেন না। অচেনা-অজানা জায়গায় ও দোকানে ওষুধ কিনলে তা নকল হতে পারে।

চার. শুধু জরিমানা করে নকল-ভেজাল ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। দুর্নীতিবাজ ওষুধ ব্যবসায়ীদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য কঠোর আইন ও শাস্তির বিধান চালু করতে হবে। সনাতনী আইন-কানুন দিয়ে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা ছয় মাস-বারো মাস জেলহাজতে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। নকল-ভেজাল ওষুধ নিয়ে যারা রোগীর জীবন বিপন্ন করে বা মৃত্যুর কারণ হয়, তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড-মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করতে হবে। নকল-ভেজাল ওষুধ খাইয়ে মানুষ হত্যা মানুষ খুনের মতোই সমান অপরাধ। সুতরাং নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া কেন বৈধ হবে না? আর এসব দুর্নীতিবাজের ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো অধিকার নেই। এদের ওষুধ ব্যবসার লাইসেন্স চিরতরে বাতিল করে দিতে হবে।

পাঁচ. ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে আরও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। গ্রাম-গঞ্জে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হারবাল ওষুধের নামে আজে-বাজে ও বিষাক্ত দ্রব্য দিয়ে সিরাপ, ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল বানিয়ে লোক ঠকাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে এ দিকটাও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : প্রফেসর, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

drmuniruddin@gmail.com