দেশের অর্থনীতি জটিল পরিস্থিতিতে

অর্থনীতির নানা সংকটের মাঝেও কিছুটা স্থিতিশীল ছিল রপ্তানি আয়। এবার সেখানেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। টানা দুই মাস দেশের পণ্য রপ্তানি কমেছে। পাশাপাশি, সরকার পরিবর্তনের পর কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসা মূল্যস্ফীতিও ফের অনিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ঋণের উচ্চ সুদের প্রভাবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, যার প্রতিফলন পড়েছে ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধিতেও। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এখন জটিল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তার ওপর রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের সীমাবদ্ধতা, জ্বালানির ঘাটতি এবং কেন্দ ীয় ব্যাংকের কঠোর নীতিমালা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে তলানির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। নেই নতুন বিনিয়োগ। আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও সুখবর নেই। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচিত সরকার আসার পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। দেশের বড় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা বিদেশে অবস্থান করছেন বা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের তুলনায় সামান্য বেশি। তবে প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতির কারণে শিল্প খাতের সম্প্র্রসারণও ব্যাহত হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভজঘট পরিস্থিতির মুখোমুখি।
এদিকে চলতি বছরে দেশের রপ্তানি খাত কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা ধ্বংসাত্মক হারে হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্টে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ শতাংশ কমে দাঁড়ায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আরও ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ হ্রাস হয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট রপ্তানি আয় ১ হাজার ২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। তবে সাম্প্রতিক দুই মাসের পতন বাণিজ্য বিশ্লেষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। অপরদিকে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও প্রকৌশল খাতের রপ্তানি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ইউরোপের চাহিদা হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিই হ্রাসের মূল কারণ। তারা বলছেন, ‘রপ্তানির ওপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, যা রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
বর্তমানে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরে সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উচ্চ সুদের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও স্থবির। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুন থেকে আগস্টের মধ্যে ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আগস্টে এটি দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ স্থগিত হয়েছে, পাশাপাশি চালু থাকা কারখানার কিছু অংশও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ঋণ ব্যয় বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ সুদ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগও বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এটাই সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে বিনিয়োগ স্থবির। সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত বা স্থগিত হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রধানত সরকারি বন্ড ও বিলেই বিনিয়োগ করছে।
তবে সেপ্টেম্বরে নিত্যপণ্যের দাম আবারও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সবজি ও কাঁচামরিচের দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগস্টের ৮ দশমিক ২৯ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গ্রাম ও শহরÑ উভয় ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বর্ষাকালের প্রভাব এবং সরবরাহ চেইনের বাধার কারণে দাম বেড়েছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর উদ্যোগ দাম বৃদ্ধিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) নির্ধারণ করা হয়। এতে খাদ্য, শিক্ষা, ইন্টারনেট ব্যয়, রেস্টুরেন্ট, বেভারেজ, তামাকজাত দ্রব্যসহ নানা খাতের তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বর্তমান ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা আগামী মুদ্রানীতিতে সুদের হার কমিয়ে এক অংকে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএসহ ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে এফবিসিসিআইয়ের মহাসচিব আলমগীর বলেন, ‘বর্তমানে দেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ১০ থেকে ১১ শতাংশ মুনাফা করেন। এত উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয়। বিশ্ববাজারে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখতে সুদের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে এক অঙ্কে আনার অনুরোধ করেছি। গভর্নর জানিয়েছেন, নীতি সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে, যা আগামী মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হবে।’
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন কমিটির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর অনুরোধও জানান। রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যাংকিং জটিলতা সমাধানে বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও তারা তোলেন, যা গভর্নর ইতিবাচকভাবে অনুমোদন করেছেন।
তবে চলতি বছরের আগস্টে দেশের ‘পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স’ (পিএমআই) সূচক কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে তা ৫৯ দশমিক ১-এ পৌঁছেছে, আগস্টে সূচক ছিল ৫৮ দশমিক ৩। সূচকের মান ৫০-এর ওপরে থাকলে খাত সম্প্র্রসারণশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, শিল্প খাত দ্রুত সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে, কৃষি ও নির্মাণ খাতও সম্প্র্রসারণে রয়েছে। তবে সেবা খাতের সম্প্রসারণ তুলনামূলক ধীর।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ জানান, ‘নতুন বাজেট বাস্তবায়ন এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষি ও নির্মাণ খাত সম্প্রসারণে এসেছে, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সেবা খাতকে ধীর রেখেছে।’
এছাড়া রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ায় চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসÑ জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ১৯১ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে দেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। জুলাইÑআগস্টে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আমদানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হারে এবং মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে প্রবাসী আয়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক প্রবণতা সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে আরও শক্ত অবস্থানে এনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উন্নতি হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও বৈদেশিক সম্পদÑ দায় সংক্রান্ত লেনদেনে ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইÑআগস্টে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি নেমে এসেছে মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
তবে সব মিলিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে দেশের বৈদেশিক খাত আগের চেয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। গত অর্থবছরেই (২০২৪-২৫) তিন বছর পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মোট পরিশোধ হিসাব উদ্বৃত্তে ফেরে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, নমনীয় বিনিময় হার এবং সরকারি রাজস্ব ও মুদ্রানীতির কৌশলগত কঠোরতা এই ইতিবাচক প্রবণতার মূল কারণ।