দুই বিভাগের সচিব পদেই রাজস্ব অভিজ্ঞদের নিয়োগ

রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞদের মধ্য থেকে নিয়োগের বিধান রেখে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে সরকার।
রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞদের মধ্য থেকে নিয়োগের বিধান রেখে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হবে।
সংশোধিত খসড়ায় এর আগে জারি করা অধ্যাদেশের ১১টি জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে দুই বিভাগের সচিব ও অন্য কর্মকর্তার পদ কীভাবে এবং কোন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে সে বিষয়ে বেশকিছু সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে। আগের অধ্যাদেশে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব পদে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছিল। এখন সেটি সংশোধন করে সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, পরিকল্পনা, রাজস্ব নীতি বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে এ বিভাগের সচিব পদে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে আগের অধ্যাদেশে রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছে এমন যোগ্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে সংশোধিত খসড়ায় অগ্রাধিকার দেয়া হবে শব্দটি বাদ দিয়ে নিয়োগ প্রদান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘সংশোধিত অধ্যাদেশে আগের জারি করা অধ্যাদেশের ১১টি ধারায় সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধিত অধ্যাদেশে রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ দুটির সচিবসহ অন্যান্য পদে কোনো সুনির্দিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তার পরিবর্তে বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।’
আগের অধ্যাদেশে রাজস্ব নীতি বিভাগের বিভিন্ন পদ আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের থেকে পূরণযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমানে এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে রাজস্ব নীতি বিভাগের আয়কর নীতি, দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মতামত, শুল্ক নীতি, মূল্য সংযোজন কর নীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমস-সংক্রান্ত চুক্তি অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে। এর পাশাপাশি সংশোধনীতে রাজস্ব নীতি বিভাগের অন্য অনুবিভাগের পদে জনপ্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, হিসাব ও নিরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ এবং আইন প্রণয়নসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূরণ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুল্ক ও আবগারি) এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর) ক্যাডারে কর্মরত জনবলের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হবে বলে আগের অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সেটি সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট ক্যাডার সার্ভিসের নাম উল্লেখ না করে রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণের কথা বলা হয়েছে।
মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে। এখন সেটি সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট ক্যাডারের নাম বাদ দিয়ে রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে।
আগের অধ্যাদেশে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক তফসিলে বর্ণিত আইনগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে নিয়োজিত পদগুলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুদ্ধ ও আবগারি) ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পূরণ করার কথা বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রেও সংশোধিত খসড়ায় সুনির্দিষ্ট ক্যাডারের নাম বাদ দিয়ে রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পূরণযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে এবং ন্যস্ত করা জনবল থেকে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে বলে এর আগের অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল। বর্তমানে এটি কিছুটা সংশোধন করে প্রয়োজনীয় জনবল বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করার কথা বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাঁচজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুসারেই অধ্যাদেশে সংশোধনী আনা হয়েছে। এটি সব দিক থেকেই ভালো হয়েছে বলে মনে হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল দাবি-দাওয়াগুলোর অধিকাংশই এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে।’
এনবিআরের কার্যক্রম পৃথক করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের বিধান রেখে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকেই এ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এক পর্যায়ে আন্দোলনের প্রভাবে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় অচলাবস্থা নেমে আসে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমও ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। এ অবস্থায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় সরকার। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এক পর্যায়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা আসে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিষয়টি সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার ঘোষণা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ জুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, বন্দর ও রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করতে একটি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে। তাছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে এ কমিটির সদস্য করা হয়। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়।