খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা

দেশের ব্যাংক খাতে ২০২৩ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুটোই বেড়েছে। গত বছর প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ সময় খেলাপি ঋণের হার ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ হয়েছে। যদিও গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের চেয়ে কমেছে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এতে ২০২৩ সাল শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ উঠে এসেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের চলমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে ব্যাংক খাতের ঋণ আদায়ে ধীরগতি অব্যাহত রয়েছে। তাই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেয়। এ সময় ঋণ পুনঃতফসিলও বাড়ানো হয়। এতে প্রতি বছরই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমতে দেখা যায়। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) খেলাপি ঋণ কমাতে শর্ত দিয়েছে। সেই শর্ত পরিপালনে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই ব্যাংকগুলো আগে থেকেই খেলাপি ঋণ কমাতে প্রস্তুতি নিয়েছে। তার প্রভাবেও কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ৩ মাস পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর হিসাবে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

যদিও আগের বছরের, অর্থাৎ ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। সেই হিসাবে অবশ্য এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৯৭৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

এদিকে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ৯ হাজার ৫৮০ কোটি বেড়ে হয় ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ৯ হাজার ২৪০ কোটি বেড়ে হয় ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৭৮০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ১২ হাজার ১৩০ কোটি বেড়ে হয় ৭৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে মাত্র ৪০০ কোটি বেড়ে হয় ৯৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ৫ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা কমে হয় ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি। আবার ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১ লাখ ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২ সালে ১৭ হাজার ৩৮৬ কোটি বেড়ে হয় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি বেড়ে হয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতির কারণে গত কয়েক বছর ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ছাড়ের কারণে অনেকে ভাবছে ঋণের টাকা না দিলে চলবে। তাই যাদের অবস্থা ভালো তারাও টাকা ফেরত দিচ্ছে না। যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বেছে বেছে এ সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে এভাবে ঢালাওভাবে ছাড় দেয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই খারাপ চর্চা। এর ফলে ভালো গ্রাহকরাও দেখা যাবে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের যে চিত্র, এটা প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মূলত এটা একটা গাণিতিক হিসাব। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সবসময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো।

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। এই পথনকশা বা রোডম্যাপের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামানো হবে, যা এখন ৯ শতাংশে রয়েছে। আর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, যা ডিসেম্বর শেষে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৯৯ ও ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তিন মাসে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ১৬ কোটি টাকা।

গত বছরের শেষে তিন মাসে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তিন মাসে কমেছে ১০ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে ৮৫ কোটি টাকা কমে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রোডম্যাপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালকদের নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে। যাতে ঋণ শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়। আর অডিট কমিটির চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র পরিচালকের মধ্যে থেকে থাকতে হবে। এতে করে অডিট কমিটির নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হবে। এমন পদক্ষেপ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। ফলে আগামীতে খেলাপি ঋণের লাগব টানা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণের স্থিতি রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রমালিকানাধী ব্যাংকের ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের ৬৬ হাজার ৪৫৬ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪০ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।