রাজারবাগ পীরের ‘শত মিথ্যা মামলা’ ও মামলাবাজ চক্র

 

বাংলাদেশে মিথ্যা মামলা, ভুয়া ওয়ারেন্ট এবং ভুয়া জামিনের পেশাদার চক্র গড়ে উঠেছে৷ আর এইসব মামলায় হয়রানি ও নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷

সম্প্রতি ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলার জন্য আলোচনায় এসেছেন ঢাকার রাজারবাগ এলাকার পীর দিল্লুর রহমান৷

গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডির তদন্তে জানা যায়, পীর দিল্লুর রহমান বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৮০০টি ভুয়া মামলা করেছেন৷ এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দেয়ার তথ্যও পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা৷

আর এইসব মামলার পেছনে আছে সাত হাজার একর জমি ও রাবার বাগান দখল৷ পীরের পক্ষে তার অনুগতরা এসব মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে ৷

বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে৷ মামলাগুলো স্থগিত করে পীরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ শুধু তাই নয়, এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাজারবাগ পীরের সব আস্তানা বন্ধের যে সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়নের জন্যও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷

তবে রাজারবাগ পীরের পক্ষে এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ৮০০ দূরের কথা, তিনি কারুর বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেননি৷

যারা মামলার শিকার হয়েছেন তাদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির জানান, ‘‘সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে, যারা মামলা করেছেন তারা পীরের মুরিদ, আইনজীবী, কর্মচারী, বাবুর্চি৷ যারা মামলা করেছেন তারা কেউ বাদীদের চেনেন না৷ মামলার উদ্দেশ্য হলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় পীরের অবৈধ জমি দখল করা অথবা দখল করা জমি নিজের আয়ত্তে রাখা৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আদালত এখন তিন ধরনের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন৷ পীরের পক্ষে করা সব মামলা একযোগে সিআইডি তদন্ত করে দেখবে৷ তারপর মামলাগুলোর ভবিষ্যত নির্ধারণ করা হবে৷ পীরের কেনো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা তদন্ত করবে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট৷ তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে পীরের সম্পদের তদন্ত করতে বলা হয়েছে৷’’

তবে রাজারবাগের পীরের এসব মামলাই দেশের একমাত্র ঘটনা নয়৷ বাংলাদেশে মিথ্যা মামলার একাধিক চক্র আছে বলে জানা গেছে৷ শুধু তাই নয় ভুয়া ওয়ারেন্ট ও জামিনেরও চক্র আছে৷

ভুয়া ওয়ারেন্টে অনেক লোকেরই হাজতবাসের ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে৷ গত বছর হাইকোর্ট এসকল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল৷ কারণ এই ধরনের চক্রের সাথে আদালতের এক শ্রেণির কর্মচারি ও আইনজীবীও জড়িত৷

আইনজীবী শিশির মনির জানান, ‘‘হাইকোর্টে এ নিয়ে একজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে৷ আর মূল কথা হলো আমাদের বিচারব্যবস্থার যে সিস্টেম তাতে মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করা সহজ৷ দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলার পর মামলা দিয়ে জীবন অতিষ্ট করে তোলা হয়৷ পঞ্চগড়ে মামলায় জামিন পেলে, কক্সবাজারে মামলা হয়, সেখানে জামিন পেলে ঢাকায় মামলা হয়৷ এভাবে চলতে থাকে৷’’

এদিকে বিদ্যমান আইনেই মিথ্যা মামলা করার ফাঁক আছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু৷

তিনি জানান, ‘‘১৯৪৪ সালের পুলিশ প্রবিধানেই বলা আছে সত্য বা মিথ্যা যে অভিযোগই করা হোক না কেন তা মামলা হিসেবে থানাকে রেকর্ড করতে হবে৷ আর কোনো মামলা মিথ্যা প্রমাণের আগে তাকে মিথ্যা বলার সুযোগ নাই৷’’

অবশ্য আদালতের রায়ের আগে তদন্ত পর্যায়েও মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে৷ তবে তা হতে হবে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে৷ তদন্ত পর্যায়ে যদি পুলিশ দেখে মামলা মিথ্যা তাহলে তদন্ত কর্মকর্তা আসামিকে অব্যহতি দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন৷ আর তখন ম্যাজিষ্ট্রেট চাইলে বাদীকে শোকজ করে তাৎক্ষণিকভাবে সিআরপিসির (দণ্ডবিধির) ২৫০ ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দিতে পারেন৷ আবার মামলার রায়ে যদি আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হন তখনো বাদীর বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিতে পারেন৷

তিনি বলেন, ‘‘তবে মিথ্যা মামলার এই প্রতিকার পাওয়ার তেমন কোনো নজির নাই৷ এটা অনেকটাই আদালতের ওপর নির্ভর করে৷’’

এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মিথ্যা মামলার ব্যাপারে আলাদাভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে৷ মামলা মিথ্যা প্রমাণ হলে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে৷