দীর্ঘ ১৮ মাসের অধিক সময় ধরে বন্ধ থাকার পর খুলেছে স্কুল-কলেজ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থীর জীবনে। স্কুল-কলেজ খোলার পর অনেকটাই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে করোনাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষত। তাসের ঘরের মতোই ভেঙেছে হাজারো স্বপ্ন। রাজশাহী জেলায় ১৮ মাসে সাড়ে ছয় হাজারের অধিক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংতার ঘটনাও বেড়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, রাজশাহীতে ষষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার ১৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী এক লাখ তিন হাজার ৪০৭ জন। এদের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ৫১২ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৬ দশমিক ২৯ শতাংশের বেশি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাঘা উপজেলায় তিন হাজার ৪৫৭ ছাত্রীর মধ্যে ১২১ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বাগমারা উপজেলায় ২১ হাজার ৩৯০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে এক হাজার ৭৮৫ জন। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি; ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। চারঘাট উপজেলায় নয় হাজার ৩১ জনের মধ্যে ৬৮৪ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
দুর্গাপুর উপজেলায় ছয় হাজার ৬০২ ছাত্রীর মধ্যে ৪৯০ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। গোদাগাড়ী উপজেলায় ১২ হাজার ৯৯২ ছাত্রীর মধ্যে ৮৭৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। মোহনপুর উপজেলায় ছয় হাজার ৫৬০ ছাত্রীর মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৫০১ জন। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পবা উপজেলায় ১১ হাজার ২৯৬ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮৩০ জন। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পুঠিয়ায় সাত হাজার ৫৮৭ জনের মধ্যে ৪৬৫ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ছয় দশমিক ১২ শতাংশ। তানোরে আট হাজার ৪৪২ জনের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৬৮০ জন। উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
উপজেলাগুলোর তুলনায় নগরীতে বাল্যবিয়ের হার অনেক কম। নগরীর বোয়ালিয়া থানায় সাত হাজার ২৫০ জনের মধ্যে ১৯ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ। মতিহার থানায় আট হাজার ৮০০ জনের মধ্যে ৬৪ বাল্যবিয়ে হয়েছে। এই থানায় বাল্যবিয়ের হার শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ।
দুর্গাপুর পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলছি। পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি। অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়ে যাবে। শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে।
দুর্গাপুর উপজেলার আমগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তসলিম আলী বলেন, সার্কের নির্দেশনা মতে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছি। নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এমনকি শিক্ষার্থীদের উপস্থিত হওয়ার জন্য বিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বাঘা উপজেলার পলাশি ফতেপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান বলেন, সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর গোপনে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এটি রোধ করা যাচ্ছে না। ছুটির মধ্যে আমার বিদ্যালয়ের ১২ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।
বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, পদ্মার চরে দুটি হাইস্কুল। এই দুটি হাইস্কুলে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।
চকরাজাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, পদ্মায় চর রয়েছে ১৫টি। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র দুটি। করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে হয়েছে। তবে বিয়ের আগে জানতে পারলে প্রশাসনকে অবগত করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমার জানামতে, ৩৫-৪০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। তারা এখন আর স্কুলে আসছে না। বছর শেষে জানা যাবে ঠিক কতজনের বাল্যবিয়ে হয়েছে।
বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম বলেন, এমনিতেই পদ্মার চরের মানুষ দরিদ্র। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হয়ে গেলে পরিবার মনে করে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা চর এলাকায় বেশি। তারপরও অনেক চেষ্টা করা হয়, সচেতন করা হয়, যেন বাল্যবিয়ে না দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ের বিষয়ে জানতে পারলে প্রশাসনকে জানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বাঘা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কাশেম মোহাম্মদ ওবাইদ বলেন, বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও যদি কোনও বাবা-মা গোপনে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, করোনাকালীন বাল্যবিয়েগুলো গোপনে হয়েছে। যা আমাদের প্রশাসনের অজানা। তবে আমরা এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য ড. একেএম মাহমুদুল হক বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই। রাজশাহীতে করোনা এতজনের প্রাণও কেড়ে নিতে পারেনি, যতজনের শৈশব, স্বপ্ন, সুযোগ ও সম্ভাবনা কেড়ে নিয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার ছাত্রীর বেশিরভাগ শৈশব উপভোগ করতে পারবে না। পারবে না নিজের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে। বাল্যবিয়ের এই ক্ষতিকর দিকের প্রভাব যে শুধু তাদের ওপর সীমাবদ্ধ থাকবে তাও না। তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বড় দুটি কারণ। এক্ষেত্রে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলায় যে বাল্যবিয়ে রোধ কমিটি আছে তাদের নিষ্ক্রিয়তা দূর করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাল্যবিয়ে রোধে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি (বিএলসি) রাজশাহী জোনাল ম্যানেজার সুফিয়া খাতুন জানান, তারা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাল্যবিয়ে রোধসহ নারী ও শিশুর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। ব্র্যাক বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। গত দুই বছরে তাদের কাছে প্রায় দুই হাজার অভিযোগ এসেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশ সামাজিকভাবে মীমাংসা করা হচ্ছে। আবার অনেকে বিচারহীনতায় ভুগছেন।
জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শবনম শিরিন বলেন, করোনায় বাল্যবিয়ে ও নারী প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, এটি সত্য। এর পেছনে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদফতর কাজ করছে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তারা আগে বাল্যবিয়ের খবর পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।