মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা: কাড়ছে প্রাণ বাড়ছে পঙ্গুত্ব

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। ফাইল ছবি
বর্তমানে সারা দেশে ৩৪ লাখ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে। নিবন্ধনহীন মোটরসাইকেলের সংখ্যাও কম নয়। এসব মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। বেঁচে যাওয়াদের সুস্থ হতে তিন সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসরা বলছেন, মোট সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় ৪২ শতাংশই মোটরসাইকেলের। অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক মোটরসাইকেল বাজারে আসছে। মুহূর্তেই গতি উঠা মোটরসাইকেলগুলো সহজে দুর্ঘটনায় পড়ে। সড়কে নানা ভঙ্গিতে গতির প্রতিযোগিতা উঠে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, গতির নেশায় লাগাম ঘর-পরিবার থেকেই টানতে হবে।

রাজধানীর রমনা এলাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক গৃহিণীকে মোটরসাইকেল নামক ঘাতক নির্মমভাবে হত্যা করে। ব্যস্ত সড়কে প্রায় ৮০-৯০ কিলোমিটার গতির চালক ওই নারীর ওপর মোটরসাইকেল তুলে টেনেহিঁচড়ে বহুদূর নিয়ে যায়। প্রচণ্ড রক্ষক্ষরণে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওই নারীর মৃত্যু হয়। একই দিন রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানার আহমেদ নগরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলেসহ তিনজন নিহত হন। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে মোটরসাইকেল আরওহী আকাশ ইকবাল (২৮) এবং তার স্ত্রী মায়া হাজারিকার (২৫) মৃত্যু হয়। এমন ঘটনা শুধু রাজধানীতে নয়, পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ঘটছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ওই সব দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশির ভাগই কমবয়সি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৭০ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৯ লাখের মতো। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তির প্রায় ৩০-৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত রোগী।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিুমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

বুয়েটের এআরআই ও নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনার। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন। এখানে উল্লেখ্য যে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহতদের হিসাবে রাখা হয় না। পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আবদুল আউয়াল রিজভী বলেন, প্রতিদিনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার রোগী আসে, সবাইকে ভর্তি করানো সম্ভব হয় না। ১০০০ শয্যার এ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু, অধিকাংশ রোগীকে ৩ সপ্তাহ থেকে ২-৩ বছর পর্যন্ত সেবা দিতে হয়। ৪০ শতাংশ খরচ সরকার করলেও ৬০ শতাংশ খরচ রোগীদের ওপর পড়ে।

বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। জরিপে উঠে আসে- ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিুমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেওয়া হয়। রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকদের প্রতিযোগিতাও কম নয়। অধিক ট্রিপ দিতে তারাও বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালান।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বলেন, এখন কিশোরীরাও গতি নিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে- কার চেয়ে কে বেশি গতি উঠাতে পারে। এই গতির মোহই যে বিপদ ডেকে আনছে, তা-ও ভুলতে বসেছে বহু অংশের মোটরসাইকেল চালক। প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যার প্রায় ২০-৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।