আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে অবৈধ লেনদেন বন্ধে কড়াকড়ি আরোপের পর ভোগান্তিতে পড়েছেন তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ গ্রাহকরা। ব্যাংকগুলোরও ক্রেডিট কার্ড ব্যবসা হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই গ্রাহকদের ভোগান্তি কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে আগামীকাল সোমবার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালকের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বেসিসের প্রতিনিধি ছাড়াও ১১টি ব্যাংকের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেবেন।
বৈঠকে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনে কড়াকড়ির পর গ্রাহকদের কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে সেটি আলোচনা হবে। বিশেষ করে গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে ফরম পূরণ করে ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, সেটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এর পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার চালুর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে, যেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে বৈধ সব লেনদেনই তাত্ক্ষণিক সম্পন্ন হবে। আর যেসব লেনদেন অবৈধ বা আইনসিদ্ধ নয়, সেসব লেনদেনের মার্চেন্ট ক্যাটাগরি কোড (এমসিসি) সফটওয়্যারেই ব্লক করা থাকবে। ফলে কেউ চাইলেও অবৈধ লেনদেন করতে পারবে না। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিজ্ঞাপন প্রদান বাবদ একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়করণের অনুমোদন প্রদান এবং ভ্রমণের দলিলাদি ব্যতীত ভ্রমণ কোটার এনডোর্সমেন্ট এবং অব্যবহৃত ভ্রমণ কোটা ভ্রমণ ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে বিকল্প হিসেবে একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এখন যেমন ক্রেডিট কার্ডে অবৈধ লেনদেন বন্ধে ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, বিকল্প ব্যবস্থায় আর ফরম পূরণ করা লাগবে না। তখন স্বংক্রিয়ভাবেই যেসব লেনদেন অবৈধ সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। সফটওয়্যারেই অবৈধ লেনদেনের কোড ব্লক করে রাখা হবে। অন্যদিকে বৈধ অন্য সব লেনদেন যখন খুশি তখন করা যাবে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এরই মধ্যে কথা হয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা করতে ব্যাংকগুলোও রাজি আছে।
আন্তর্জাতিক ক্রডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা কেনার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে গত ১৪ নভেম্বর সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সার্কুলারে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে বিদেশি পণ্য বা সেবা কিনতে হলে গ্রাহককে অনলাইন ট্রানজেকশন অথরাইজেশন ফরম (ওটিএএফ) পূরণ করে মোবাইল অ্যাপ বা ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বা হার্ড কপি ব্যাংকে জমা দিতে হবে। ব্যাংক যাচাই-বাছাই করে অসংগতি না পেলে ক্রেডিট কার্ডকে শুধু সেই লেনদেনের জন্য সক্রিয় করে দেবে। ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া ওই কার্ড কাজ করবে না। মূলত অবৈধ লেনদেন বন্ধ ও অর্থপাচার রোধের যুক্তি দেখিয়ে এ সার্কুলার জারি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দ্বৈত মুদ্রার কার্ডের মাধ্যমে অর্থপাচারের কোনো তথ্য বা ঝুঁকি দেশি-বিদেশি কোনো প্রতিবেদন বা প্যানেল আলোচনায় উঠে আসেনি বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারে এ ধরনের পূর্বানুমোদনের বিধান বিশ্বের কোথাও নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো খাতে লেনদেন বন্ধ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট মার্চেন্ট ক্যাটাগরি কোড (এমসিসি) বন্ধের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু তা না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সার্কুলারে সব লেনদেনের বিষয়ে ওটিএএফ পূরণ করতে বলা হয়েছে। এতে গ্রাহকরা আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবেন এবং নগদ ডলার বহনের ঝুঁকি নেবেন বলে মত তাঁদের। তা ছাড়া ওটিএএফ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকগুলোকে সার্বক্ষণিক অফিস চালু রাখতে হতে পারে, যা বাস্তবে দুরূহ। যেমন এখন প্রতিটি লেনদেনের জন্য আলাদা করে ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। ফলে জরুরি কাজে কোনো লেনদেন করার প্রয়োজন হলে তখন ব্যাংকের অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংক খোলা থাকে আট ঘণ্টা। ফলে এই আট ঘণ্টার মধ্যে সব অনুমোদন নিতে হবে। রাতে তো আর ব্যাংক খোলা থাকবে না। কিন্তু অনেক লেনদেন জরুরি প্রয়োজনে রাতেও করতে হতে পারে।
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সার্কুলারের ফলে ই-কমার্সভিত্তিক স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) তাদের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে।
বিদ্যমান নিয়মে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহক এককভাবে কোনো পণ্য বা সেবামূল্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ নিতে পারেন।