একবার ভাবুন তো, বাইশ বছর বয়সী একজন যুবক দেশের প্রত্যন্ত উপকূলে বসে উড়াচ্ছেন মিগ-২৯ কিংবা বাংলাদেশ বিমানের ড্রিমলাইনার। বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান দেখতে দেখতেই ছোট্ট ছেলেটি স্বপ্ন দেখত একদিন আকাশ ছোঁয়ার। শুনতে হয়তো গল্পের মতো লাগছে, তবে আকাশ ছোঁয়ার এই গল্পটাই সত্যি করেছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলার তরুণ মোহাম্মদ আশির উদ্দিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা মডেলের বিমান, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন বানিয়ে রীতিমতো চমকে দিয়েছেন সবাইকে। প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই নিজের মেধা আর পরিশ্রমে তৈরী করেছেন এসকল উড়োযানের মডেল।
ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আগ্রহ আশিরের। স্বপ্ন ছিল অনেক বড় কিছু করার। তবে ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। এসএসিতে ৩.৯ জিপিএ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরবর্তীতে বাঁশখালির স্থানীয় একটি কলেজ থেকে মাত্র ৩.৫ জিপিএ নিয়ে পার হন এইচএসসির গন্ডি। ভর্তি হয়েছিলেন একটি পলিটেকনিক কলেজে। তবে আশিরের তৈরি করা এসকল উড়োযানের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নজরে আসে সংশ্লিষ্ট অনেকের। আর তার অনন্য এই মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ আশির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এন্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়টি আকাশ বিজ্ঞান প্রকৌশল সম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এন্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন আশির। বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের জন্য আশিরের উদ্ভাবনী মেধা কাজে লাগানোর কথা ভেবেই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও সে যেভাবে কাজ করেছে, অনেক সুযোগসুবিধা পেলেও অন্যের জন্য তা করা কঠিন। এভিয়েশন অপারেশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. জহির উদ্দিন জানান, আশিরের বিমান তৈরির ভিডিওটি ফেসবুকে তাঁর স্ত্রী দেখতে পেয়ে তাঁকে দেখান। তিনি সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গ্রুপে শেয়ার করেন। পরে তা উপাচার্য নজরুল ইসলামের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি আশিরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে নির্দেশ দেন।
চার বছর সময় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নয় ধরনের বিমান তৈরি করেছেন আশির। শুধু তাই নয়, ব্যাটারিচালিত একটি স্পিডবোটও বানিয়েছেন তিনি। নিজের হাত খরচের টাকা বাচিয়ে কিনেছেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। স্বপ্ন দেখেন একদিন তার তৈরী করা যাত্রীবাহী বিমান উড়ে বেড়াবে নীল আকাশে। আশির বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চান তার উদ্ভাবন দিয়ে। আর সে জন্য এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করছেন তিনি। তার এই অর্জন সেই স্বপ্নের পথে প্রথম পদক্ষেপ। বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে খোদ বিমান বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে আশিরের জন্য বিশাল প্রাপ্তি। আশিরের এই অর্জনে গর্বিত তার পরিবারের সকলে। তাদের উৎসাহ এবং সহযোগিতায় এতোদূর আসা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্থানীয় প্রতিবেশী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। প্রতিদিন অসংখ্য উৎসাহী মানুষ তার এসব উড়োযান দেখতে আসেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশিরের মতো এরকম অনেক মেধাবী সুযোগের অভাবে নিজের প্রতিভাকে তুলে ধরা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বের সামনে। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল নয়, একাগ্রতা এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়েও যে নিজ ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া সম্ভব তার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত আশির। প্রচলিত পড়াশোনার বাইরেও মেধা এবং সৃজনশীলতার বিচারে এগিয়ে থাকা এসব তরুণদের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেকটা নীরবেই হয়তো তৈরী হচ্ছে আশিরের মতো মেধাবী তরুণেরা। তাদের হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ পৌঁছাবে নতুন উচ্চতায়, এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।