জিনান মাহমুদ :
ফেঁসে যাচ্ছেন প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম এ করিম। দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড মিটিং এ বিষয়টি নিয়ে চৃড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে- এমনটাই জানিয়েছেন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচ।
এর আগে কোম্পানীর শত কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এম করিম ও অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। শুধু তাই নয়, কোম্পানির বর্তমান কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার পর আসামীদের তালিকা আইডিআরএ’র কাছে পাঠাতে বলা হয়।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’র পরিচালক (আইন) মোহাম্মদ শফিউদ্দীন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
চিঠিতে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম এ করিমসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানির ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, গাড়ি ক্রয় বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার, প্লট ক্রয়ে ১৬ কোটি ৭০ লাখ ৪০ হাজার ও চট্টগ্রামস্থ আসকারবাদ মৌজার ফ্লোর স্পেস ক্রয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
আদালতের নির্দেশক্রমে গত ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মেসার্স হুদাভাসি চৌধুরী এন্ড কোং চার্টার্ড একাউন্টস ফার্ম কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শত কোটি টাকা আত্নসাতের চিত্র ফুঁটে উঠে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া অনুমোদনহীন এজেন্টকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকা প্রদান, আবাসিক প্রকল্পে প্লট ক্রয়, চট্টগ্রাম ও সিলেটে জমি ক্রয়, গাড়ি কেনা, ইসলামী (তাকাফুল) বীমার সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। আত্মসাতের সঙ্গে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম. এ করিম, এনায়েত আলী খান ছাড়াও তৎকালীন সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বীমা বিভাগ) মো. মনিরুজ্জামান খান এবং সিনিয়র ব্যবস্থাপক (ইসলামী বীমা তাকাফুল বিভাগ) মো. রফিকুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট ১৯ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
এ সব অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরবর্তীতে দুদক থেকে এই অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইডিআরএ কাছে পাঠানো হয়। আইডিআরএ প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করে। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ৩৮টি অনিয়ম চিহ্নিত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। প্রগ্রেসিভ লাইফ দুটি চিঠির মাধ্যমে তাদের অনিয়মের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিকট প্রেরণ করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ, ২০১৩ সালে আর্থিক বিবরণীতে অনাদায়কৃত প্রিমিয়ামের যে সমন্বয় করা হয়েছে তা আইন সম্মত ছিল না। দ্বিতীয় অভিযোগে দেখা যায়, কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে কালেকশন এন হ্যান্ড দেখানো হয়েছে ৩০ কোটি ১৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯৪ টাকা। কিন্তু পলিসি নম্বর ও টাকার অন্যান্য ব্রেকআপসহ ২৭ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার টাকার বিবরণ পাওয়া যায় বাকী ৩ কোটি ১৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের আর্থিক বিবরণীতে সেটা সমন্বয় করা হয়েছে, যা আইন সম্মত নয়।
তৃতীয় অভিযোগে দেখা যায়, কোম্পানির ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন বন্ধ সার্ভিস সেলের ব্রাঞ্চ পেটি ক্যাশের আউটস্ট্যান্ডিং ব্যালেন্স এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সার্ভিস সেলগুলোর ইন-চার্জের নামে উক্ত টাকা আগাম দেয়া হয়েছিল কিন্তু টাকাগুলো আদায় করা হয়নি। তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বিপরীতে কোন কাগজপত্রও দলিলাদি দেখাতে পারেনি।
এছাড়া পলিসি লোনের উপর জমা সুদ ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং লোন ও অগ্রিমের উপর জমা সুদ ৩১ লাখ ২৮ হাজার ক্যারিড ফরোয়ার্ড থেকে দেখানো হয়েছে। যার উৎস খুজে পাওয়া যায়নি। এই টাকা ২০১৩ সালের আর্থিক বিবরণীতে বেআইনিভাবে সমন্বয় করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে অর্থআত্মসাৎ মামলায় যাদের অপরাধী হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে তাদেরকে টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একইসাথে অনিয়মকৃত অর্থ আদায়ে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, ঢাকায় সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সি আর মামলা করা হয়- যা বিচারাধীন রয়েছে।
এ বিষয় জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এম. এ করিম বলেন, প্রগ্রেসিভ লাইফে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি।
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এবং মামলার নির্দেশ থাকার পরও কিভাবে বর্তমানে কোম্পানির পরিচালক পদে রয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি অসুস্থ। আমার নামে মামলা করবে কে? এ বিষয়ে অফিসে গিয়ে কথা বলেন।’’
কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, ‘‘দুদক এবং আইডিআরএ’র থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কোম্পানির বোর্ড মিটিং এ বিষয় আলোচনা হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করে আইডিআরএ কে জানানো হবে।’’