অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩৭৮ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে প্রতিদিনই শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে ৫ আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিএফআইইউ, এনবিআর এবং দুদক যৌথ প্রচেষ্টায় ২ হাজারের বেশি অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ১৬ হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইউ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা বিদেশে পাচার করেছে তাদের সম্পদ দেশে ফেরত আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু আমাদের দেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে, সুতরাং আমরা পারব না কেন? এগমন্টের দেশসমূহ, যাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে, নতুন চুক্তি সম্পাদন করে এবং ইন্টারপোলের সাহায্যে এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, এসকল ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। যেখানে মামলার সংখ্যা ১১৫টি। এই পর্যন্ত ৯৫টি চুড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর আগে গেল ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৬৬ জন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছিলো সংস্থাটি। ওই সময়ে মামলা ছিলো ১১২টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম; সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানবসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আকবর সোবহান ও এসকল ব্যাক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব।
সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সঙ্গে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউর। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্ভব্য সব দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্ত সংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার। এই টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বিএফআইইউ।
পাচারের টাকা ফেরাতে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
বিএফআইইউয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপসহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমত, পাচারের সঠিক তথ্য উদ্ধার, পরিমাণ নির্ণয় ও পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে আগানো হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
দুর্নীতিসহ অনিয়ম ও অপরাধের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কিংবা ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অনেক প্রভাবশালী। কেউ কেউ বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। গণমাধ্যমে এসব খবর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হলেও দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ তাঁদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভাগটি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এখন প্রায় প্রতিদিনই এ বিভাগ সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে, আটকে দিচ্ছে ব্যাংকে থাকা লকার। তলব করছে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য। এসব হিসাবে হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত থাকার তথ্য মিলছে। এই হিসাবগুলো যাঁদের নামে, তাঁদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও আছেন। তাঁদের ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থের উৎস ও আয়ের নথি খতিয়ে দেখছে বিএফআইইউ। সেই সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার (ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে।
দেশ ও বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেও তা প্রতিরোধে গত ১৫ বছরে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএফআইইউ। এ অভিযোগে সরকার পতনের পর বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করে পদত্যাগে বাধ্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তখন তাঁর কক্ষ ও ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অর্থ পাচারসংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিও।
এসএস