সৌদি আরবে প্রায় সাড়ে তিন বছর গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন আফরোজা বেগম (ছদ্মনাম)। উপসাগরীয় দেশটিতে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হন এবং নিয়মিত প্রাপ্য বেতনও পেতেন না। তারপরও ২৫ বছর বয়সী ফরিদপুরের বাসিন্দা আফরোজা দেশে রেখে যাওয়া অসুস্থ স্বামীকে সহায়তা করার জন্যই সেখানে থেকে যান।
তবে, গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আসার পর ঘটনাপ্রবাহ বদলে যায়।
শুধু আর্থিক অনটন নয়, দেশে ফেরার পর কোনো অভিজ্ঞতাই সুখকর হয়নি তার। নিজ সম্প্রদায়ের এক শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে কটূক্তির শিকার হতে শুরু করেন।
অনেক মানুষ তার প্রতি নোংরা মন্তব্য ছুড়ে দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা নারী অভিবাসী কর্মীদের যৌন হয়রানির ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমাকে ঘিরেও কিছু গল্প তৈরি করে।’
আফরোজার মতো অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন আরও অনেকেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাস ফেরত নারী শ্রমিকরা তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাধ্যমে সামাজিকভাবে ঘৃণার শিকার হচ্ছেন এবং সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের প্রতি অনভিপ্রেত মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে ‘বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমন্বয়: সফলতা ও ব্যর্থতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ৩১৩ জন নারী অভিবাসীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ মনে করেন ফিরে আসার পর তাদের প্রতি মানুষের ‘মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কর্মীরা ‘নিম্নশ্রেণির মানুষ’ হিসেবে বিবেচিত হন। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন।
২৭ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব নারী শ্রমিকরা প্রায়ই কটুক্তির শিকার হন এবং তাদের নিয়ে প্রচুর কানাঘুষা চলতে থাকে।
তবে, প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া নারীদের কেউ, কখনোই কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাননি।
ওমানে গৃহকর্মী হিসেবে ৫ বছর কাজ করেছেন এরকম আরেক অভিবাসী কর্মী জানান, ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আসার পর তার বিদেশে থাকা নিয়ে সামাজিকভাবে হেনস্থা করা হয়। তিনি জানান, কিছু ‘খারাপ মানুষ’ ইঙ্গিতে বলেছেন, নারী শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে ‘অনৈতিক কাজের’ সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
তবে, এ ধরনের অভিযোগ বাস্তবতা থেকে বহু দূরের বিষয়। তিনি বলেন, ‘আমার নিয়োগদাতা ছিলেন একজন নারী। তিনি আমার প্রতি সদয় ও যত্নশীল ছিলেন এবং সময়মত বেতন পরিশোধ করতেন।’
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে যশোর, ফরিদপুর ও চট্টগ্রাম জেলার ৪টি করে উপজেলায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ কর্মী সৌদি আরব, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও জর্ডান থেকে ফিরে এসেছেন।
ওই গবেষণার প্রধান গবেষক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত নিম্ন আয়ের সম্প্রদায়ে অভিবাসী নারী কর্মীদের ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়; এ কারণে যে তারা অন্যান্য নারীদের তুলনায় বেশি পরিমাণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। তবে, দেশে ফিরে আসার পর তারা এই ক্ষমতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেন।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) ডেপুটি ডিরেক্টর (গবেষণা) মনিরুল বলেন, ‘তাদের প্রতি আর কেউ সম্মান জানায় না, তারা তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করতে পারেন না এবং অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ না থাকা সত্ত্বেও বাসা থেকে বের হতে পারেন না।’
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার আরেক বিদেশ ফেরত নারী কর্মী (৩৭) তার গ্রামের বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া মানসিক অত্যাচারের কথা জানিয়েছেন। একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী হওয়ায় তার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল।
তার কাছে এই বিষয়টিকে খুবই অন্যায্য মনে হয়। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে একা বড় করতে গিয়ে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, আর আমি মানুষের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাইনি।’
তিনি তার আয়ের মাধ্যমে নিজের গ্রামে একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেছেন এবং ২১ বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে স্থানীয় কলেজে পড়তে পাঠান।
দেশে ফিরে আসার পর তিনি এখন যশোরের স্থানীয় কারখানাগুলোতে দিনমজুরের কাজ এবং মাঝে মাঝে কাপড় সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সব কিছুর পরও গ্রামবাসীর বিষাক্ত কথার ঝাঁজ সহ্য করা তার কাছে আরও বেশি কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অপ্রত্যাশিতভাবে অথবা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন।
৩৮ শতাংশ নারী জানান, তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৫২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ৬১ শতাংশ নারী প্রবাসে থাকার সময় প্রায়ই খাবার ও পানির অভাবে কষ্ট পেয়েছেন বলেও জানান।
মূলত ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রবাস ফেরত নারীদের এক চতুর্থাংশ তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্ত। অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক নারীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই।
বিআইএলএস এর কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, ‘প্রবাস ফেরত নারীদের প্রতি সামাজিক ঘৃণার অবসান ঘটাতে হলে কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।’
এ ছাড়া, গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রবাস ফেরত নারী কর্মীদের ৯০ শতাংশই মনে করেন, তাদের জন্য একটি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।
এ অবস্থায় বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন কাঠামো ও আলাদা সুরক্ষা সেল থাকা উচিৎ বলে মনে করেন মনিরুল ইসলাম।