মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ :
বীমা সময়ের চাহিদা। ব্যক্তি ও সম্পদের নিরাপত্তার চিন্তা শুধু সরকারের নহে। ব্যক্তিকে পরিবার, কর্মী ও অন্যান্য সকল চিন্তার সাথে সাথে সম্পদের চিন্তাও করতে হয়। কারণ এগুলো এক অর্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তাই আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোটর বীমায় যেন ব্যক্তি ও সম্পদের নিরাপত্তা থাকে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বলেছেন। যা এক কথায় যথার্থই বলেছেন।
আমরা যারা নন-লাইফ বীমা পেশায় জড়িত আছি তাঁরা জানি থার্ড পার্টি বীমায় বীমা গ্রহীতার নিজের গাড়ীর ক্ষতিপূরণ ছাড়া প্যাসেঞ্জার, ড্রাইভার, হেলপার এবং থার্ড পার্টির গাড়ী ও রাস্তায় চলাচলকারী পথিক ও থার্ডপার্টির সম্পদের ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ক্ষতিপূরণের হার খুবই নগন্য এই হারকে কতটা যুক্তি সংগত করা যায় তা বিবেচনায় নিতে হবে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং-মিস্-৮০/২০০৮-এ একটি নির্দেশনা আছে যে, অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিয়ে ক্ষতিপূরণের হার আরো ৯(নয়) গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়। যা নিম্মরূপঃ-
ক) কোন ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য পলিসিরি ক্ষতিপূরন অংক + আরো ৯ গুন = ২,০০,০০০/- (সর্বোচ্চ দুই লাখ) টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে।
খ) কোন সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্থ হলে পলিসির ক্ষতিপূরন অংক + আরো ৯ গুন = ৫,০০,০০০/- (সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ) টাকা ক্ষতিপূরন পাবার সুযোগ আছে।
প্রতি যাত্রীকে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরন দিতে হলেও ৯(নয়) গুন অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আদায় করতে হবে।
বীমা ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাঁরা সকলেই জানি থার্ড পার্টি বীমার পয়সা দিয়ে বীমা কোম্পানীর শাখাগুলোর মাসিক অফিস খরচ অনায়াসেই চলে যায়। যা থার্ড পার্টি বীমা বন্ধের কারণে শুধু যে নন-লাইফ বীমা কোম্পানীই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নয়, সরকারও হারাচ্ছে ভ্যাট ও বীমা ষ্ট্যাম্প বাবদ অকল্পনীয় রাজস্ব।
আমাদের দেশে বীমার অবস্থা এমন যে ঠেলায় না পড়লে কেউ বীমা করতে চায় না। আমরা ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান নই একথাটি আমাদের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহোদয় ৩০/০৯/২০২০ইং তারিখের স্মারক নং ৩৫.০৩.০০০০.০০৩.৩১.০২৬.১৯-২৬৫৫-এর মাধ্যমে জানিয়েছেন “যে থার্ড পার্টি বীমা বাধ্যতামূলক নয় এবং কোন গাড়ীর থার্ড পার্টির বীমা করা না থাকলে মোটরযান মালিকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী কোন মামলা দেয়ার সুযোগ নেই”।
সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বীমা বিশেষজ্ঞ নহেন। সড়ক ব্যবস্থাপনা তাদের কাজের অংশ বীমা নহে। তাই তাদের এই ধরনের আইন প্রণয়ন ও নিদের্শনা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাজে প্রত্যক্ষভাবে বাঁধা প্রদানের সামিল।
আমরা জানি পৃথিবীর কোন দেশেই এই ধরনের আইন বিদ্যমান নেই। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের আওতায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কাজ করে না। সরকারের রাজস্ব আয় এবং জনগনের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই সরকারের সকল ধরণের বিভাগ রয়েছে। তাঁরা কোনভাবেই সরকারের আয়ের উৎস ও সরকারী সিদ্ধান্তের বিপরীতে কাজ করতে পারে না। যেমন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৬০ উপধারা (১), (২), (৩) লক্ষ্য করুনঃ
১। কোন মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোন মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।
২। মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান উহার অধীন পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বীমা করিবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি বা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বীমার আওতাভুক্ত থাকিবে এবং বীমাকারী কর্তৃক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাইবার অধিকারী হইবেন।
৩। মোটরযান দুর্ঘটনায় পতিত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্থ হইলে বা নষ্ট হইলে উক্ত মোটরযানের জন্য ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল হইতে কোন ক্ষতিপূরণ দাবী করা যাইবে না।
অর্থাৎ ৬০ ধারা অনুযায়ী মোটরযানের কোন ক্ষতি হলে সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩ এর অধীনে মালিকগণ তাদের অনুদানে গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে কোন ক্ষতিপূরন দাবী করতে পারবেন না। এই কথার মানে এই নয় যে, বীমা করা যাবে না।
বীমার উন্নয়নের জন্য সরকার একটি আইনের মাধ্যমে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ২০১০ গঠন করেছেন। সরকারের আইন বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনী রয়েছে। সকলকে বাইপাস করে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা ভেবে দেখার বিষয়।
আমরা যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে স্মরন করি তাহলে দেখবো যে তিনি জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাই নয় যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণের কথাও বলেছেন। তার বক্তব্যের ভিত্তিতে আমার ক্ষুদ্র ধারনাটি এভাবে বর্ণনা করতে চাই। বিজ্ঞজনেরা বিবেচনা করে দেখবেনঃ
১। আমরা সাধারণতঃ নতুন বা রিকন্ডিশন গাড়ীর রেজিষ্ট্রেশনের পর ০৫(পাঁচ) বছরের জন্য কমপ্রিনেসিভ বা সকল ধরনের ক্ষতির বীমা করে থাকি। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। যদি প্রিমিয়াম কিছুটা কমানো যায় তা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের রেটিং কমিটি বিবেচনায় নিবেন।
২। থার্ড পার্টি বীমা অবশ্য চালু করতে হবে তা যে নামেই হউক বা যে ফরমেটেই হউক না কেন, ০৫(পাঁচ) বছর মেয়াদ অতিক্রান্তের পর পরবর্তী ০৫(পাঁচ) বছর একটি নির্ধারিত মূল্য ধরে গাড়ীর বীমার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোন ব্যক্তি নিজের গাড়ী, থার্ড পাটির্র গাড়ী, পেসেঞ্জার ও রাস্তায় চলাচলকারী পথিক সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন।
৩। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং-মিস্-৮০/২০০৮ অনুযায়ী ৯ গুন প্রিমিয়াম বাড়িয়ে ৯ গুন ক্ষতিপূরণ প্রদান। যা ১০(দশ) বছর পর গাড়ীর লামসাম মূল্য ধরে করা যেতে পারে।
এই প্রক্রিয়ার ফলে ব্যক্তি ও সম্পদ নিরাপদ থাকবে, বীমা কোম্পানীগুলোর আয় বাড়বে, সরকারী রাজস্বের বৃদ্ধি সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়ক হবে।
লেখক: মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ।