দেশের সাধারণ গণপরিবহনে যাত্রীসেবার মান খুবই শোচনীয়। ঢাকা নগরীতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারীরা ঠিকমতো পরিবহনে উঠতে পারেন না। আবার কোনোভাবে উঠতে পারলেও অনেকসময় নানারকম অপমান ও হয়রানির শিকার হন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় উঠে আসে দেশের শতকরা ৮৩ জন নারী সড়কে চলতে গণপরিবহনের শ্রমিকদের মাধ্যমে হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন। নারীর ওপর এই যে মানসিক ও শারীরিক যৌন হয়রানি-এটাকে তেমন আমলে নেয়া হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে নারী যাত্রীরা রয়েছেন সংকটে।
শনিবার বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে ‘গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে গবেষণার এ তথ্য উঠে আসে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর আয়োজন করে। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
সাইদুর রহমান বলেন, দেশে প্রতিদিন গণপরিবহনে কমবেশি ৬০লাখ সিট ট্রিপ হয়, এর মধ্যে ২০ শতাংশ থাকেন নারী। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ সিটে নারীরা শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরিসহ নানা কাজে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। কিছু পুরুষ যাত্রী পিকআওয়ারে নারীযাত্রী তুলতে হেলপার-ড্রাইভারদের নিরুৎসাহিত করেন। ফলে রোদ-বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নারীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
সাইদুর রহমান বলেন, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের বড় একটি অংশ বলছেন, তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এসব প্রকাশ করতে বিব্রত বোধ করেন। মাঝে মধ্যেই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সে কারণে বেশিরভাগ নারী গণপরিবহনকে নিরাপদ মনে করেন না। প্রধান কারণ এখানে প্রতিবাদের সংস্কৃতি অনুস্থিত। পুরুষরা খুব কমই এসব ঘটনায় প্রতিবাদ করেন। ফলে গণপরিবহনে ক্রমাগত নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি ঘটেই চলছে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক হাজার ১০০ নারীকে নিয়ে এ গবেষণা পরিচালনা করে বলে জানানো হয়।
নারীরা অভিযোগ করেছেন, গণপরিবহনে যৌনহয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় তারা অনেক সময় পুলিশের কাছেও প্রতিকার পান না। বরং উল্টো নারীকে যেসব প্রশ্ন করা হয় সেগুলো এক ধরনের নিগ্রহ। এই পরিস্থিতি প্রতিকারে কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরি বলে জানানো হয়।
প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন:
লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, আইন দিয়ে গণপরিবহনে নারীর হয়রানি বন্ধ করা যাবে না। এখানে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। সবাইকে তার নিজের যায়গায় সতর্ক থাকতে হবে যে তাকে দিয়ে কোনো নারীর হয়রানি না হয়। সামাজিকভাবে এ বিষয়ে সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিবহন সেক্টরে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ইউরোপে এ সংখ্যা ২২ শতাংশ। আমাদের দেশে সব সেক্টরে মিলিয়ে ৩৬ শতাংশ নারী কাজ করেন। তবে, গণপরিবহনে একেবারে নেই বললেই চলে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা শেলী বলেন, নারীবান্ধব গণপরিবহনের জন্য মালিক শ্রমিকদের আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজকেও সোচ্চার হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যেমে নৈতিকবোধ জাগ্রত করতে হবে।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি কর্মসূচির সমন্বয়কারী হোসনে আরা বেগম বলেন, সামগ্রিকভাবে আমাদের এ বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। পরিবহন খাতে সেবা প্রদানকারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবে শুধু বাসের ড্রাইভার বা হেলপারদের সচেতন করলেই হবে না। যেখান থেকে গাড়িতে উঠে সেখানের পরিবেশ ভালো রাখতে হবে। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে বিষটি তুলে ধরতে হবে। যাত্রীদের আচরণ বিষয়ে সচেতনতাসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
আলোচনায় পত্রিকার প্রকাশিত গণপরিবহনে নারী নির্যাতন, ধর্র্ষণ ও হত্যার ঘটনা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। সেখানে উঠে আসে- গণপরিবহনের শ্রমিকদের দিয়ে ৫০ শতাংশ নির্যাতন ঘটে মহাসড়কে, আঞ্চলিক সড়কে ঘটে ২৫ শতাংশ এবং রাজধানীর অভ্যন্তরীণ সড়কে ঘটে ২৫ শতাংশ। টহল পুলিশ কম থাকে এমন স্থানসমূহে সাধারণত এসব অপরাধ সংঘটিত হয়। এরমধ্যে মাঝারি পাল্লার বাসে ঘটে ৩৫ শতাংশ, আন্তঃশহর বাসে ৩০ শতাংশ, স্বল্পদূরত্বের লোকাল বাসে ২০ শতাংশ এবং দূর পাল্লার সিটিংবাসে ১৫ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২১ জন ভিকটিমের ওপর কেস স্টাডি করে দেখা গেছে, ১৩ জন সংঘবদ্ধ ঘর্ষণ, ৫ জনকে ঘংঘবদ্ধভাবে ধর্ণণচেষ্টা এবং তিন জনকে এককভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১৩ শতাংশকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৫০ শতাংশকে ধর্ষণের পর চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। এসব আপরাধ সংঘটনকারীদের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। অধিকাংশ ঘটনার সাথে পরিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার জড়িত। আবার কিছু পরিবহনের শ্রমিকদের সাথে পেশাদার অপরাধীরা জড়িত ছিল। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নোয়াখালী অঞ্চলে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে।
সুপারিশ:
নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বন্ধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন দশটি সুপারিশ তুলে ধরে।
এর মধ্যে রয়েছে- ড্রাইভার ও হেলপাদের জেন্ডার ও রোড সেফটি বিষয়ে অবশ্যই ওরিয়েন্টেশন এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবহন মালিকদের দায়িত্ব নিতে হবে। গণপরিবহনের নাম্বার প্লেট গাড়ির ভেতরেও দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করতে হবে, যাতে যাত্রীরা প্রয়োজন বোধে নাম্বারটি তার স্বজদের জানিয়ে রাখতে পারেন। একইসাথে হেল্প লাইনে মেসেজ পাঠাতে পারেন। সড়কের যাত্রী ছাউনিগুলো দখলমুক্ত করে নতুন ও আধুনিক যাত্রীছাউনি নির্মাণ করতে হবে, যাতে নারীরা রোধ-বৃষ্টিতে আশ্রয় নিতে পারেন। গণপরিবহনে নারী নির্যাতনরোধে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, সকল যানবাহনে ভেহিক্যাল ট্রাকিং সিস্টেম (ভিটিএস) ডিভাইস স্থাপন করতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যানবাহনকে চিহ্নিত করা যায়। গণপরিবহনে ডাবল গেটের ব্যাবস্থা থাকা উচিত, যাতে যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে উঠতে ও নামতে পারেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের হেড অব- রোড সেইফটি প্রোগামের ডা. কামরান উল বাসেত সহ বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধি।