দেশে ভয়াবহ হারে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ থেকে অবসাদ, বেকারত্ব, পরিবার ও কর্মস্থলে অবহেলা, সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা, যৌথ পরিবার ভেঙে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হওয়া, মাদকের আগ্রাসন, জীবনযাপনে প্রযুক্তির অতিনির্ভরতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারকে মানসিক রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১ লাখে ছয় জন আত্মহত্যা করছেন মানসিক সমস্যার কারণে। মানসিক রোগের কারণে এখন সন্তানের হাতে বাবা-মা আর বাবা-মায়ের হাতে সন্তান খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। খুন ও ধর্ষণ বাড়ছে। অবসাদে ভোগা এসব রোগী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অবসাদগ্রস্ত এসব তরুণকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে সহজে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফেলছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষ চিকিত্সা নেয় না অজ্ঞতার জন্য। শারীরিক রোগের জন্য মানুষ যেভাবে এগিয়ে যায়, সেভাবে মানসিক রোগের জন্যও এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে মানসিক রোগ বিভাগ আছে, বড় বড় কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। হালকা সমস্যার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ আছে, সেখানেও মানুষ যেতে পারে। সমস্যা আছে, সমাধানও আছে। যেটা বাধা, সেটা হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে দেশে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। আগের অবস্থান থেকে মানুষ খারাপ অবস্থানে চলে গেছে—এ সবই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। একটা হচ্ছে লস ইভেন্ট, আরেকটা হচ্ছে থ্রেট ইভেন্ট। কারো চাকরি চলে গেছে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনো ব্যক্তি ভালো বাসা ছেড়ে দিয়ে খারাপ বাসায় উঠতে হয়েছে—এসবের সঙ্গে ডিপ্রেশন জড়িত। আর থ্রেট ইভেন্টের সঙ্গে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জড়িত। আমরা হিংস্রতা দেখেছি; নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখেছি। করোনার কারণে বহু লোক স্বজন হারিয়েছে। এসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়েছে। শুধু সাতক্ষীরায় শত শত বাল্যবিবাহ হয়েছে। যাদের লেখাপড়া করার ইচ্ছা ছিল, যাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে, যাদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে, তাদের মানসিক সমস্যা হবে। ঘরে ঘরে আমরা লক্ষ করেছি, শিশুদের হাতে আমরা মোবাইল সেট, ল্যাপটপ দিয়েছি; এসবে শিশুদের ব্রেইন ওয়াশ হয়েছে। এতে তাদের মনোযোগ বই থেকে মোবাইলের দিকে চলে গেছে। এতে মা-বা উৎকণ্ঠায় ভুগছেন। এসব মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়। পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছে, নারী-শিশু নিপীড়ন ঘটেছে। এসব তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। করোনাকালে ঘরে ঘরে মাদক সাপ্লাই হয়েছে কুরিয়ারে। মাদক সেবনে মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। ডিভোর্স-সেপারেশনের হার বেড়েছে। এসবও মানসিক সমস্যা তৈরি করছে।
করোনাকালে মানসিক রোগের প্রবণতা, বিষণ্নতা, উদাসীনতা বেড়েছে। এপ্রিল, ২০২১-এ ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, করোনা থেকে সেরে ওঠার প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই প্রতি তিন জনে এক জনের মধ্যে এমন মানসিক সমস্যা দেখা গেছে, যার চিকিত্সা প্রয়োজন। করোনাকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে অ্যাংজাইটি আর ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্ণতার লক্ষণ পাওয়া গেছে।
মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলেও জানান তারা। অনেক সময় মানুষ বোঝেই না যে, আচরণগত সমস্যাটি ঐ ব্যক্তির মানসিক রোগের কারণে হয়েছে। তারা বলছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঐ সব ব্যক্তি একপর্যায়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৫০০ শয্যার হাসপাতালে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর দুই মাসে শুধু বহির্বিভাগেই চিকিত্সা নিয়েছে ১০ হাজার ২৭০ জন রোগী। এ ছাড়া ইনডোরে ভর্তি হয়েছে ২৪৮ জন, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি মাসে বহির্বিভাগে রোগীদের যে সেবা দেওয়া হচ্ছে, তা গত পাঁচ বছর আগেও ছিল মাত্র দেড়-দুই হাজার।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের হিসাবে দেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য এই মুহূর্তে ২৭০ জন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক রয়েছেন। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন, যেটা অপ্রতুল। এক বছরে ৭ থেকে ১০ জনের বেশি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রস্তুত হচ্ছে না বলেও জানানো হয়। যে কারণে অনেকেই এই সেবা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে আজ দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।
ব্যক্তিজীবনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, নানামুখী চাপ, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, অপ্রাপ্তি, লোভ, বিচারহীনতা মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে মানসিক রোগীতে পরিণত করছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্ব জুড়ে মানসিক রোগী বাড়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে এই কারণগুলো। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছেন। এছাড়া উদ্বেগাধিক্যে (অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার) ৮ দশমিক ৪, বিষণ্ণতায় (ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার) ৪ দশমিক ৬, গুরুতর মানসিক রোগে (সাইকোসিস) ১ দশমিক ১ এবং মাদকাসক্তিতে (ড্রাগ অ্যাডিকশন) শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ লোক ভুগছেন। এদিকে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রন্তের হার আরও বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশই মানসিক রোগে আক্রান্ত। এছাড়া এই বয়সী শিশুদের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ মানসিক প্রতিবন্ধী, ২ শতাংশ মৃগীরোগে আক্রান্ত এবং শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ মাদকাসক্ত।