কচি তালশাঁসের মতো টলটলে চোখে অন্তহীন জানার ইচ্ছে, ঠোঁটে হাসি, শিশুসুলভ চাঞ্চল্য, আর খেলনাপাতি- ট্রাই সাইকেল। আর মা-বাবা, ভাইবোন। পরিপূর্ণ সংসারের আনন্দ। সবার আদর ও মমতায় সিক্ত ও অভিষিক্ত। মায়াঘেরা জীবন। রাসেল, আজ তোমার জন্মদিন! জন্মদিনে অভিনন্দন জানাই। ভালোবাসা জানাই।
বেঁচে থাকলে তুমি এখন পরিণত বয়স ও মানসের একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের পাশে থাকতে। সত্যান্বেষী, সাধারণ মানুষের প্রতি মমতায় দ্রবীভূত একটা মন। অন্যায় দেখলে ক্ষুব্ধ হতে, প্রতিবাদ করতে, প্রতিরোধের আয়োজন করে জ¦লে উঠতে। তা নিরসনের জন্য প্রাণপাত করতে। এর জন্য প্রাণ দিতেও তুমি কুণ্ঠিত হতে না। কারণ এ বিশেষত্ব তুমি সহজাতভাবে পেয়েছিলে, বাকি সবসময়, সমাজ ও পরিপাশর্^ থেকে অর্জন করতে। কিন্তু তা হতে পারেনি। পৃথিবীর এক জঘন্য হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছ তুমি, পিতা-মাতা ও অনেক আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। বেঁচে থাকলে এমন যে কোনো কলুষিত চক্রান্ত কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। রুশো বলেছিলেন, প্রত্যেক শিশুই অশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ তার মধ্যে নিহিত থাকে মানবীয় বিকাশের অন্তহীন সম্ভাবনা। কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার অভাব তীব্র। তোমার ও তোমার মতো যারা অকাল-নিহত দেশে ও বিশ^জুড়ে, তোমার সঙ্গে তাদের কথাও মনে পড়ে।
মা-ভাইবোনের মমতাময় সান্নিধ্য যতটা পেয়েছ, পিতার সান্নিধ্য ততটা তুমি পাওনি। অন্যায়ে প্রতিবাদ করতে করতে তোমার বাবাকে জেলখানার ক্ষুদ্র পরিসরে জীবনের অনেকটা সময় কাটাতে হয়েছে। তোমাকে বোঝানো হয়েছে, জেলখানাই তোমার বাবার বাসা। তুমি তা মানতে চাইতে না। জেলখানা কারও ঠিকানা হতে পারে না। এই বোধ থেকে তুমি নির্মিত ও অনির্মিত সব কারাগারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। দেশ বা বিশ^কে তুমি কারাগার হতে দিতে না, কারও জন্যই নয়। অন্তত মুক্তপ্রাণ স্বদেশ ও মানুষের জন্য যারা লড়াই করে, করে চলে, তাদের সঙ্গে তুমি আত্মার নৈকট্য অনুভব করতে। একাত্ম হতে।
শিশুদের জন্য, নারীদের জন্য, বঞ্চিত মানুষের জন্য তোমার মন কাঁদত। হৃদয়ের তীব্র আকুলতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে তুমি। তারুণ্যকে, যৌবনকে, জীবনের সব অধ্যায়কে মানব-সংলগ্নতার মধ্য দিয়ে জীবন ও পরিপাশর্^কে অর্থবহ করে তুলতে তুমি। প্রকৃতির প্রতি তোমার প্রাণের টান বনভূমি, নদ-নদী পরিবেশকে সতেজ ও ¯িœগ্ধ করে রাখত। পশুপাখিও নিগৃহীত হতে পারত না। দেশ হয়ে উঠত সব মানুষের আপন। স্বর্গের চেয়ে মহিমাময়। বিদ্বেষের বিষে কেউ ছটফটিয়ে মারা পড়ত না। এ দেশ হয়ে উঠত আরও গভীরভাবে প্রাকৃতিক ও মানবিকভাবে ভারসাম্যময়। এর জন্য কোথাও কোথাও নিশ্চয় কঠোর হতে হতো, যারা মানুষ হয়েও পৈশাচিক আচরণ করে, অন্যের সম্পদ ও সম্পত্তি কেড়ে নেয়, নানা অজুহাতে মানুষকে যন্ত্রণার আগুনে তিল তিল করে পুড়িয়ে মারে, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে, বিদেশে অর্থ পাচার করে, মানুষকে প্রতারণার মধ্য দিয়ে সর্বস্বান্ত করে, নানা বর্গে ভাগ করে অত্যাচারকে স্থায়ী করতে চায়, দেশের প্রকৃত উন্নতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তাদের- তুমি দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রবল প্রতাপে রুখে দিতে। রাষ্ট্রের যে কোনো পদে বহাল থাকুক না কেন, ছদ্মবেশধারী মানবতার সেই আত্মপরায়ণ শত্রুদের চিনে নিতে তোমার কোনো ভুল হতো না। তাই তোমার সঙ্গে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলাত সবাই। মানবমনের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের এই আনন্দে আকাশে-বাতাসে মেঘের মতো ভেসে বেড়াত আনন্দিত মেঘমালা। আকাশ থেকে ঝরে পড়ত নানা বর্ণগন্ধময় ফুল। তাদের বুকভরা মধু। পতঙ্গরাও উল্লসিত হতো, পাখিরা ডানা মেলে দিত, মাছেরা লেজ নাড়িয়ে চলে যেত দূর থেকে দূরে, ফিরে আসার বাসনা নিয়ে। সবাই তার নিজস্ব জলে বা স্থলেই সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা চায়, তা সত্য হয়ে উঠত। স্বদেশে কেউ পরবাসের বেদনায় কুণ্ঠিত-কুঞ্চিত হয়ে থাকত না।
রাসেল, প্রিয় রাসেল, তোমার জন্য আমাদের খুব মন পোড়ে। নিরন্তর সুন্দর অনন্ত এক সম্ভাবনা কে হারাতে চায়? বিশেষ করে আমি যখন তোমার সমবয়সী, আমার জন্মের দুদিন আগে তুমি এই পৃথিবীতে, পৃথিবীর এক বঞ্চনাপীড়িত দেশে আবির্ভূত হয়েছিলে! আর দেশ যখন নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পল-অনুপল পার করছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা রক্তক্ষয়ের সুদীর্ঘ কালপর্ব পার হয়ে অর্জিত এ বাংলাদেশের সর্বত্র, শুভচেতনাবাহী মানুষের মনে ও মর্মে। তোমার মুখচ্ছবির মতো সুন্দর নির্মল ও মায়াময় একটা বাংলাদেশই তো আমরা চাই। এটাই তো সঙ্গত। এটাই তো সরস, সুরেলা ও শান্তিময় এক প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন, প্রিয় রাসেল! তোমাকে খুব মনে পড়ে, তোমার জন্য আমাদের মন পোড়ে