চীনা অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে শিল্প উৎপাদনের শ্লথগতি

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট চীনের শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে যা দৃশ্যমান হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকতে যাচ্ছে শেষ প্রান্তিকেও। বিশেষ করে অক্টোবরে শিল্প খাতের উৎপাদন কার্যক্রম যেভাবে সংকুচিত হয়েছে, তাতে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নীতিনির্ধারকদের সামনেও নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে শিল্পের বর্তমান এ পরিস্থিতি।

অতিমারী-পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিল চীন। সে লক্ষ্যে দ্রুত অর্থনৈতিক কার্যক্রমও শুরু করেছিল দেশটি। কিন্তু তাতে বাদ সাধে শিল্প কাঁচামালের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদায় মন্দা ভাব দেখা দেয়। ফলে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপির ওপরও এর প্রভাব পড়ে। শিল্প খাতের এ মন্থর গতি শেষ প্রান্তিকের প্রথম মাস বা অক্টোবরেও অব্যাহত ছিল। গত মাসে প্রত্যাশার চেয়ে কমেছে এ খাতের সূচক। টানা দ্বিতীয় মাসের মতো এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (এনবিএস) তথ্য বলছে, অক্টোবরে উৎপাদন খাতের পারচেজিং ম্যানেজার’স ইনডেক্স (পিএমআই) দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ২ পয়েন্টে। যেখানে আগের মাসে এর অবস্থান ছিল ৪৯ দশমিক ৬ পয়েন্টে। যদিও এ মাসে সূচকের অবস্থান ধরা হয়েছিল ৪৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট। সেই হিসেবে প্রত্যাশার চেয়ে শিল্প খাতের উৎপাদন কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে ৫০ পয়েন্ট।

কভিডের অভিঘাত মোকাবেলা করে চলতি বছর থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছিল চীন। এজন্য টিকা কার্যক্রমে গতি আনাসহ অন্যান্য সুরক্ষামূলক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশটি। তবে সেই গতি রোধ করে বিশ্বজুড়ে শিল্প কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি ও তীব্র জ্বালানি সংকট। যার প্রভাব পড়ে বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও খাতগুলোতে। দেশটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান এমনিতেই ধুঁকছিল, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে ওঠে। এ খাতে প্রবৃদ্ধির গতি ২০২০ সালের মার্চের পর সর্বোচ্চ দুর্বল হয় গত সেপ্টেম্বরে।

এনবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ওই মাসে উৎপাদক পর্যায়ে মূল্যসূচক (পিপিআই) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এটি এনবিএসের তথ্য সংগ্রহের ইতিহাসে সূচকে সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফনের রেকর্ড। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৬ সাল থেকে শিল্প উৎপাদনের ডাটা একত্র করা শুরু করে। ফলে ওই সময়ের পর সূচকে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয় সেপ্টেম্বরে। উৎপাদক পর্যায়ে ব্যয় বৃদ্ধির এ চিত্র সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। রয়টার্সের অর্থনীতিবিদরা ওই মাসের জন্য পিপিআই বৃদ্ধির পূর্বাভাস করেছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। মূলত আগস্টে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির পর এ পূর্বাভাস করেছিল তারা। কিন্তু সব পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণিত করে পিপিআই সূচক রেকর্ডে পৌঁছে।

চীনা অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হলো শিল্প খাত। ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর অর্থনীতির উত্থান-পতন অনেকটাই নির্ভর করে। কিন্তু কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদায় গতি না আসায় উৎপাদন কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চায়না লজিস্টিকস ইনফরমেশন সেন্টারের বিশ্লেষক জাং লিকুয়ানের বক্তব্যে ভোক্তা চাহিদার ক্রমহ্রাসমান চিত্র উঠে এসেছে। তিনি জানান, এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানি পণ্যের পর্যাপ্ত চাহিদা সংকটের মুখোমুখি রয়েছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা-সংক্রান্ত জটিলতা তাদের উৎপাদন থেকে দূরে রাখছে। আবার উৎপাদন সক্ষমতার যেটুকু ব্যবহার হচ্ছে, সেটির ব্যয় বাড়ছে বহুগুণ। ফলে এটিতে অর্থনৈতিকভাবে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে না।

পরিসংখ্যানও বলছে শিল্প উৎপাদনের ব্যয় বাড়ছে। শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয়ের নির্দেশক সূচকটিতে ২০১৬ সাল থেকে প্রকাশ করে আসছে চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস। এ সময়ের মধ্যে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ। শিল্প উৎপাদন খাতে অব্যাহত ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ করছে বলে মনে করেন পিনপয়েন্ট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিওয়েই ঝাং। তিনি বলেন, ২০০৫ সাল থেকে উৎপাদন সূচকটি প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও কভিডের প্রভাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই কেবল সূচকটি নিম্নমুখী প্রবণতায় রেকর্ড করে। এ দুটি হিসাবের বাইরে এই প্রথম এতটা নিম্নমুখী হলো সূচক। বিপরীতে উৎপাদন খরচ ২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চে। সূচকের এমন অবস্থান এটাই বার্তা দেয় যে চীনের অর্থনীতি এরই মধ্যে একধরনের স্থবিরতার মধ্যে পড়েছে।

উৎপাদনের খাতের বাইরে অন্যান্য খাতও এখনো প্রত্যাশার তুলনায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে উৎপাদন-বহির্ভূত খাতের পিএমআই কিছুটা বেড়েছে। অক্টোবরে সূচকটি ৫২ দশমিক ৪ পয়েন্টে উঠেছে। গত সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৫৩ দশমিক ২। অন্যদিকে সেবা খাতের ঘুরে দাঁড়ানো দৃশ্যমান হলেও সেটির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে অক্টোবরে চীনের উত্তরাঞ্চলে নতুন করে কভিডের ক্লাস্টারভিত্তিক সংক্রমণ বৃদ্ধি এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সংক্রমণ ঠেকাতে আবারো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে এ খাত।