দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে চালু হতে যাচ্ছে সরাসরি পণ্য পরিবহনসেবা। নতুন এ সেবা চালু করতে এগিয়ে এসেছে সুইজারল্যান্ডের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কমোডিটি সাপ্লাইস এজি। শুরুতে তিনটি জাহাজ দিয়ে সরাসরি পণ্য পরিবহন হবে স্পেনের বার্সেলোনা ও নেদারল্যান্ডসের রটারড্যাম বন্দরে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, দেশের বন্দরে বড় জাহাজ চলাচল করতে না পারায় বর্তমানে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যেমন—সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, শ্রীলংকার কলম্বো পোর্ট হয়ে ইউরোপ পৌঁছাতে সময় লেগে যায় এক মাস থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত। নতুন এ উদ্যোগে সময় লাগবে মাত্র ২০ দিন। এছাড়া ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যেখানে ভাড়া লাগছে ১৪ হাজার ডলারের বেশি, এক্ষেত্রে লাগবে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে শিগগিরই কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে। এজন্য অনুমতি দেয়াসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নেয়া হয়েছে। ইউরোপের দেশে সরাসরি পণ্য পরিবহন সেবায় প্রতি কনটেইনারে পাঁচ হাজার ডলার সাশ্রয় হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে জাহাজকে খালিও আসতে হচ্ছে না। ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি জাহাজসেবা যাতে টেকসই হয়, সেজন্য সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। এ উদ্যোগ সমুদ্র বাণিজ্যে খরচ কমিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারায় ইউরোপের দেশে পণ্য আনা-নেয়া করতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রথমে ফিডার জাহাজে করে সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে নেয়া হয়। এরপর সেখান থেকে বুকিং পাওয়ার পর ইউরোপগামী বড় জাহাজে তুলে দেয়া হয়। এতে সময় ও খরচ বেশি লাগে। কিন্তু সরাসরি ফিডার জাহাজে স্পেন ও নেদারল্যান্ডসে পণ্য পাঠানোর এ উদ্যোগের ফলে কম সময়ে ও কম খরচে সরাসরি কনটেইনার পণ্য পৌঁছাবে।
শিপিং খাতে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে এখন কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়া রেকর্ড ছুঁয়েছে। বিশ্বজুড়ে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ৫ থেকে ১০ গুণ বেড়েছে। এমনকি অতিরিক্ত ভাড়া পরিশোধ করেও জাহাজে কনটেইনার পরিবহনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এ সংকটই মূলত দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি জাহাজসেবা চালু হওয়ার নতুন একটি পথ খুলে দেয়। এ পরিস্থিতিতে ছোট জাহাজ দিয়ে সার্ভিস চালু করায় প্রতি কনটেইনারে অন্তত পাঁচ হাজার ডলার সাশ্রয় হবে।
নতুন এ সেবা চালুর উদ্যোগ নেয়া কমোডিটি সাপ্লাইস এজির তিনটি জাহাজের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ বণিক বার্তাকে বলেন, চালু হওয়ার পর ২০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য পৌঁছে যাবে স্পেনে। সময় কম লাগবে অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন। পরিবহন ভাড়াও এতে কমে আসবে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানিতে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ঠিক করেন বিদেশী ক্রেতারা। ফলে সময় ও বাড়তি ভাড়ার চাপ কমলে আরো বেশি ক্রেতা আকৃষ্ট হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে ইতালিতে বাইসাইকেল ও তৈরি পোশাক পণ্য নিয়ে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়। দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের সঙ্গে ইউরোপের কনটেইনার জাহাজ চলাচল। এর বাইরে চীনের বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের নতুন আরেকটি সেবা চালু হচ্ছে। ‘বেঙ্গল সার্ভিস’ নামে নতুন এ সেবা চালু করছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মেডিটেরিয়েন শিপিং কোম্পানি বা এমএসসি।
সরাসরি জাহাজ চলাচলের উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। কারণ বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ৬০ শতাংশ ইউরোপের দেশগুলোয় যায়। সেবাটি প্রসারিত হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ও ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ছোট জাহাজে হলেও সরাসরি পণ্য রফতানির উদ্যোগ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে নতুন ক্রেতা সৃষ্টিতেও বড় ভূমিকা রাখবে। এজন্য জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর জাহাজ জট আমাদের বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ক্রেতাদের হাতে পণ্য দ্রুত পৌঁছাতে পারলে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়বে। কারণ আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, হংকং আগে থেকেই সরাসরি ইউরোপে পণ্য রফতানি করে আসছে।
বিদেশী ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা বাংলাদেশে বেসরকারি ডিপোগুলোয় রফতানিকারকের পণ্য বুঝে নেয়। এরপর বিদেশী ক্রেতাদের খরচেই নেয়া হয় নিজ দেশে। চট্টগ্রামে পণ্য বুঝে নিলেও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে যাওয়ায় পরিবহনে যেমন খরচ বেশি হচ্ছে, তেমনি সময়মতো পণ্য হাতে না পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই হয় ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে। ইউরোপ থেকে থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি যাতায়াতকারী জাহাজের সংখ্যা বাড়লে সময় কমে সমুদ্রপথে পরিবহন ব্যয় অনেক সাশ্রয় হবে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার রুটে জাহাজ পরিচালনার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর পাশাপশি মাদার ভেসেল ভেড়ানোর উপযুক্ত গভীর ও আধুনিক সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার কাজও দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে।