চার বিমা কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ

বিমা আইন ২০১০-এ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকা ও নন-লাইফের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৪০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু পুঁজিবাজারে বিমা খাতে তালিকাভুক্ত লাইফ খাতে প্রোগ্রেসিভ লাইফ ও রূপালী লাইফ এবং নন-লাইফ বিমা খাতের অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। এতে সরাসরি বিমা আইন লঙ্ঘন হলেও নীরব ভূমিকায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

বিমা আইন, ২০১০-এর ২১ (ক) ধারায় বলা হয়, লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে। যার ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তাগণ কর্তৃক প্রদত্ত হবে। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত থাকবে। আর (খ) নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৪০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে। যার ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তাগণ কর্তৃক প্রদত্ত হবে। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ জনসাধারণের জন্য উš§ুক্ত থাকবে। আর একই আইনের ১৩০ ধারায় বলা হয়, এ আইন পরিপালনে ব্যর্থতা কিংবা লঙ্ঘনজনিত কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচালক বা ব্যক্তিকে অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে এবং এ লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। এছাড়া ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূলধন-সংক্রান্ত জাতীয় সংসদে সংশোধিত আইন পাস হয়।

উক্ত আইনে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা এবং নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে আইনে বলা হয়েছে, সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মূলধন সময়ে সময়ে পরিবর্তন করতে পারবে। সেই আইন মোতাবেক বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত গত ১৭ জানুয়ারি এক নির্দেশনায় ২১(৩) ধারা পরিপালনপূর্বক আগামী এক মাসের মধ্যে তফসিল-১ অনুযায়ী, ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে আইডিআরএকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, জীবন বিমা খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০০ সালে কার্যক্রম শুরু করেছিল প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের ধারণকৃত শেয়ার আছে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ (৬৪ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৭টি শেয়ার)। অথচ বিমা আইন ২০১০ অনুসারে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন থাকার কথা ৩০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ জোগান দেবে উদ্যোক্তা পরিচালকরা। কিন্তু বাস্তবে উল্টো চিত্র। গত ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণ ছিল ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা চলতি বছর ৩১ জানুয়ারিতে কমে হয়েছে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণ কমেছে।

একই অবস্থা লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতের আরেক কোম্পানি রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ২৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ জীবন বিমা খাতে পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার নিচে রয়েছে ২টির। আর সাধারণ বিমা খাতের অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স এবং প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের পরিশোধিত মূলধন ৪০ কোটি টাকার নিচে রয়েছে। এর মধ্যে অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের ৩১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

তালিকাভুক্ত ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৭টি ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা শেয়ার রয়েছে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি। কোম্পানিগুলো হলোÑবাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স ও সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। অন্যদিকে উদ্যোক্তা শেয়ার ৬০ শতাংশের নিচে রয়েছে ৪৪ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এর মধ্যে ১৬টি কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ার ৩৫ শতাংশেরও কম রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলোÑঅগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, সেন্ট্রাল, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, কর্ণফুলী, নর্দান, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম, প্রভাতী, পূরবী, রিপাবলিক, ফারইস্ট লাইফ, মেঘনা লাইফ, পদ্মা লাইফ, পপুলার লাইফ, রূপালী লাইফ ও সন্ধানী লাইফ।

এ বিষয়ে আলাপকালে প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানির সচিব মোহাম্মদ জহির উদ্দিন বলেন, পরিশোধিত মূলধন ও উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণ বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত এখনও পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়নি। আর যখন নেবে তখন আমরা প্রকাশ করব।

বোর্ড পুনর্গঠন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি কোম্পানির বোর্ড তো যখন তখন যে কেউ চাইলে ঢুকতে পারে না। এ বিষয়ে নিয়মনীতি আছে, সেগুলো পরিপালন করতে হয়। তবে বাইরে থেকে নতুন কেউ আসার সুযোগ নাই।’

এ বিষয়ে তাকাফুল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ২০ শতাংশ স্পন্সর শেয়ার হোল্ডিং কম আছে। পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণ করার জন্য একটা নির্দেশনা ছিল। কয়েকজন পরিচালকের শেয়ার কেনার সামর্থ্য থাকলেও সবার একসঙ্গে কেনার সক্ষমতা নেই। তাই একটু সময় লাগছে। তবে এটা দ্রুত হওয়া উচিত। সবার জন্য ভালো হবে।

একই বিষয়ে জানার জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৯টি ইন্স্যুরেন্সের মধ্যে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৩৭টি ও লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১২টি।