কেমন হতে হবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সংবিধানের এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী। তাই বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন জরুরি। যেহেতু নূরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই শেষ হবে, তাই অনতিবিলম্বে আইনটি প্রণয়ন করা আবশ্যক।

গত ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন না করার প্রধান কারণ হলো রাজনীতিবিদদের কোনোরূপ বিধিনিষেধের দ্বারা সীমাবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ। একটি আইন প্রণীত হলে কিছু বিধিনিষেধ মেনে এবং নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে কমিশনে নিয়োগ দিতে হতো। ফলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাকে ইচ্ছা তাকে টেবিলের নিচ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হতো না। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনোভাবে তাদের হাত-পা বাঁধা পড়ুক তা রাজনীতিকেরা চাননি, তাই তাঁরা সাংবিধানিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে আইনটি প্রণয়ন করেননি।

তবে সংবিধান মেনে ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হলে জনস্বার্থ সমুন্নত রাখার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতো। সর্বস্তরে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই জনস্বার্থ সমুন্নত থাকে। কারণ, এর মাধ্যমেই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা জনগণের কল্যাণে কাজ করে। তাই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পদ্ধতিগতভাবে নিয়োগ পেলে কয়েকজন সঠিক ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে এটিই হলো আমাদের সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা। আমাদের বিজ্ঞ সংবিধানপ্রণেতাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল যে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থান্বেষীদের পরিবর্তে জনকল্যাণমুখী ‘অনারেবল’ বা সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সরকার জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন করবে, যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। আমাদের সংবিধানপ্রণেতাদের আরও বিশ্বাস ছিল যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ সব স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আস্থা নিয়ে আইনটি প্রণীত হবে, যাতে এটি কার্যকারিতা অর্জন করতে পারে।

নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর আইনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিধান থাকতে হবে। প্রথমত, কমিশনে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য কারা যোগ্য হবেন, কারা যোগ্য হবেন না, তা সুস্পষ্ট থাকতে হবে। আইনে যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত থাকলে যে কাউকেই কমিশনে নিয়োগ দেওয়া দুরূহ হবে। যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিরূপণের লক্ষ্যে সম্ভাব্য নিয়োগপ্রাপ্তদের তঁাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে হলফনামার মাধ্যমে তথ্য প্রদানের বিধান থাকতে হবে।

একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হলেও সঠিক ব্যক্তিরা যে কমিশনে নিয়োগ পাবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন হবে ক্ষমতাসীনদের ‘অনেস্ট ইনটেনশন’ বা সৎ উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়ত, কমিশনে নিয়োগের লক্ষ্যে সঠিক ব্যক্তিদের বাছাইয়ের জন্য একটি প্রক্রিয়া নির্ধারিত থাকতে হবে। এ প্রক্রিয়া হতে পারে দলনিরপেক্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন। এ অনুসন্ধান কমিটি সংসদ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হতে পারে। কিছু প্রতিবেশী দেশের মতো সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটিও থাকতে পারে। একটি চরম বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান জাতীয় সংসদ কার্যত নির্বাহী বিভাগের করায়ত্ত হয়ে যাওয়ায় একটি বিশেষ কমিটিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের দায়িত্ব প্রদান কতটুকু যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। প্রসঙ্গত, আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অসাংবিধানিক বলে সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন।

তৃতীয়ত, অনুসন্ধান কমিটির কার্যপ্রণালি স্বচ্ছ হতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির সব সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ থাকতে হবে এবং তা গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশের জন্য নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটির প্রত্যেক সদস্যের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত লিপিবদ্ধ থাকতে হবে এবং তা প্রকাশ করতে হবে।

চতুর্থত, নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে গঠিত নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠতম সদস্যকে অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

পঞ্চমত, নির্বাচন কমিশনের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন অনুসন্ধান কমিটির প্রাথমিক বাছাইয়ের ভিত্তিতে তৈরি প্যানেলভুক্তদের নাম তঁাদের হলফনামাসহ প্রকাশ এবং তাঁদের সম্পর্কে গণশুনানির আয়োজন করতে হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের নামের তালিকা ও কোন যোগ্যতা বিবেচনায় তঁাদের বাছাই করা হয়েছে, সে সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করতে হবে এবং সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে জনগণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার যুক্তিসংগত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপনের আকারে নিয়োগ প্রদান করবেন।

উপরিউক্ত বিধানগুলো সন্নিবেশিত করে সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের একটি খসড়া আমরা প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছি। আশা করি, সরকার খসড়াটি নিয়ে সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা মনে করি যে এর জন্য এখনো পর্যাপ্ত সময় সরকারের হাতে আছে।

একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হলেও সঠিক ব্যক্তিরা যে কমিশনে নিয়োগ পাবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন হবে ক্ষমতাসীনদের ‘অনেস্ট ইনটেনশন’ বা সৎ উদ্দেশ্য। তবে আইনের মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের, সম্ভাব্য নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার এবং একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়োগ প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হলে নির্বাচন কমিশনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগের পথে কিছু ‘গার্ডরেইল’ বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

এ ছাড়া নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ রয়েছে, নির্বাচন কমিশন যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ হলো সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ না করলে সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে এবং জালিয়াতির নির্বাচন হলে তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচন বাতিল করতে পারে। তাই চরম বিরূপ পরিস্থিতিতেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থার ইনটিগ্রিটি বা গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।

পরিশেষে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের ঘোষণা ইতিমধ্যে প্রদান করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সংবিধানে আইন প্রণয়ন না করে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে কমিশনে নিয়োগ প্রদানের কোনো বিধান নেই। আর যেহেতু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুযায়ী, শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত অনুসন্ধান কমিটি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত হবে। সে অনুসন্ধান কমিটি এবং তার সুপারিশে গঠিত নির্বাচন কমিশন কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক থেকেই যাবে। আশা করি, সরকার সে পথে হাঁটবে না।

● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)