স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরে উদযাপিত হবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী।
সার বিতরণ ব্যবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল। সেচ ব্যবস্থা পুরোপুরি সনাতন পদ্ধতিনির্ভর। বীজের নতুন জাত সম্প্রসারণের মতো কার্যকর কোনো প্রতিষ্ঠানও ছিল না। এমন এক পরিস্থিতিতে গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। স্বাধীনতার পর গতি পায় সংস্থাটির কার্যক্রম। এরপর গত পাঁচ দশকে কৃষকের কাছে সার, বীজ ও সেচের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন এনেছে বিএডিসি। হয়ে উঠেছে দেশের কৃষির আধুনিকায়নের রূপকার। বিশেষ করে কৃষি উপকরণ সরবরাহের দিক থেকে এখন কৃষকের আস্থার শীর্ষে অবস্থান করছে বিএডিসি।
বিএডিসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। কৃষকের মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ জোগান ও দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে পাঁচটি উইংয়ের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম সমন্বয় করছে সংস্থাটি। এগুলো হলো বীজ ও উদ্যান, ক্ষুদ্র সেচ, সার ব্যবস্থাপনা, অর্থ ও প্রশাসন। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে উচ্চফলনশীল (উফশী) বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ বৃদ্ধি করা, সেচ প্রযুক্তি উন্নয়ন, ভূউপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে সেচের আওতাভুক্ত এলাকা বাড়ানো, কৃষকের সেচদক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মানসম্পন্ন সার সরবরাহ করা। এছাড়া সারা দেশে কৃষি উপকরণ উৎপাদন, সংগ্রহ (ক্রয়), পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা টেকসইকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার মতো কাজগুলোও করে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে গত ছয় দশকের ব্যবধানে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে বিএডিসি। ১৯৬১ সালে সংস্থাটির কাজ শুরু হয়েছিল মাত্র ১৩ দশমিক ৮ টন বীজ সরবরাহের মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় দেড় লাখ টন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে সংস্থাটি। বর্তমানে দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতরণকৃত বীজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই সরবরাহ করছে বিএডিসি।
কৃষকের কাছে বীজ সরবরাহের জন্য বারি, ব্রি ও বিনা থেকে ভিত্তিবীজ বা ব্রিডার সিড সংগ্রহ করা হয়। বিএডিসির ফার্মগুলোয় এসব ব্রিডার সিড থেকে তৈরি করা হচ্ছে ফাউন্ডেশন সিড বা ভিত্তিবীজ। ফার্মগুলোর মধ্যে রয়েছে দত্তনগর ফার্ম, মধুপুর ফার্ম, ঠাকুরগাঁও ফার্ম, নসিপুর ফার্ম ও দশমিনা ফার্ম। এসব ফার্মে উৎপাদিত ভিত্তিবীজ সরবরাহ করা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনকারীদের কাছে। তাদের উৎপাদিত বীজ ডিলারদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে সারা দেশে কৃষকদের কাছে।
সংস্থাটির সার সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬২-৬৩ সালে। ওই অর্থবছরে মাত্র ৫০ হাজার টন সার সংগ্রহ ও বিতরণ করেছিল সংস্থাটি। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহীত ও বিতরণকৃত সারের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ টনেরও বেশি। সারের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পণ্যটির আমদানি বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিলার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের ধারণক্ষমতাও বাড়িয়ে চলেছে বিএডিসি। সংস্থাটির অধীন বেশকিছু গুদাম সরকারি অন্যান্য সংস্থা ব্যবহার করছিল। সেগুলোও আবার বিএডিসির অধীনে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ সালেও যেখানে বিএডিসির মোট ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ৯৮ হাজার টন, বর্তমানে দেশের ৮৫টি স্থানে অবস্থিত বিএডিসির ১১৩টি গুদামের মোট ধারণক্ষমতা বেড়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার টন ছাড়িয়েছে।
শুরু থেকে দেশের সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি। বিএডিসির কল্যাণে এরই মধ্যে দেশের আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশকে সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। শুরুতে সংস্থাটির সেচ কার্যক্রম ছিল দেশের হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, নদ-নদীর ভূউপরিস্থ পানিনির্ভর। শক্তিচালিত পাম্প ব্যবহার করে এ পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হতো। সংস্থাটি ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে গভীর নলকূপ ও ১৯৭২-৭৩ সালে অগভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি দ্বারা সেচ সুবিধা দিয়ে আসছে। সেচে নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় আশির দশকে। ওই সময় থেকে কৃষকদের পানি ব্যবহার এবং সেচযন্ত্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে বিএডিসি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় বীজ, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে সেচ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনা এবং পানির দক্ষ ব্যবহার বাড়ানো। পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি পরিবেশেও দেখা যাচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে বিএডিসি।
এরই অংশ হিসেবে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক রাবার ড্যামের মাধ্যমে ভূউপরিস্থ পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচে সরবরাহ নিশ্চিতে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় একটি করে মোট দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার পাহাড়ি এলাকায় ২৫টি ঝিরিবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক বীজ সরবরাহে বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। দেশে প্রতি বছর সাড়ে ১২ লাখ টন বীজের চাহিদা রয়েছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে চাহিদার মাত্র ৪৫ শতাংশ। বাকি ৫৫ শতাংশ হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে। আমন ও আউশে হাইব্রিডসহ ভালো মানের জাত সম্প্রসারণে বিএডিসি ভূমিকা নিতে পারে। সার বিতরণ ব্যবস্থাপনা এখন একটি কাঠামোর মধ্যে এসেছে। তবে এখানেও প্রতিষ্ঠানটিকে নীতিগত কিছু বিষয়ে আরো শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিএডিসির বিদ্যমান সার মজুদ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান গুদামগুলোর সংরক্ষণ পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন সার বিতরণের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএডিসির চেয়ারম্যান এএফএম হায়াতুল্লাহ বলেন, দেশের আধুনিক কৃষির গোড়াপত্তনকারীর ভূমিকা নিয়েছে বিএডিসি। গবেষণা ও উদ্ভাবন, নতুন নতুন প্রযুক্তি, জাত ও পদ্ধতি কৃষকের কাছে ছড়িয়ে দিতে শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে নানা কুসংস্কার, প্রতিবন্ধকতা ও সামাজিক বাধার মোকাবেলা করতে হয়েছে। এসব বাধাকে জয় করেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের আধুনিক কৃষির রূপকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে। সামনের দিনে এ সফলতা ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোগ যুক্ত হবে। সেজন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো আধুনিক ও লাগসই কৃষিকে এগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় কৃষকের অবিচল আস্থাটি ধরে রাখা।