কুড়িগ্রামে ৩০ ভাগ পরিবারে ৩ বেলা ভাত জোটে না

 

তিন বেলা নিয়মিত খেতে পারেন না কুড়িগ্রামের প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবারের মানুষ। আর সার্বক্ষণিক খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে ৯ শতাংশকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) শীর্ষ দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাটি নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে আসে।

‘হোয়াই ইজ পভার্টি সো পারভাসিভ অ্যান্ড ইনক্রিজিং ইন সাম ডিস্ট্রিক্টস ইন বাংলাদেশ?’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ এবং জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ড. এসএম জুলফিকার আলী। এমন খবর প্রকাশ করেছে বণিক বার্তা।

গবেষণার তথ্য মতে, জেলার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার এখনো দরিদ্র। গত ছয় বছরে জেলাটিতে দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। জেলার সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ মানুষের আয় এখানকার মোট আয়ের মাত্র ২ শতাংশ। আবার গত ১০ বছরে আয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি প্রায় ৩৫ শতাংশ পরিবারের। অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন জেলার স্থানীয় বাসিন্দারা। জেলার মোট পরিবারের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই নিয়মিতভাবে তিন বেলা খেতে পায় না। আবার মাঝেমধ্যে খাদ্য ঘাটতিতে থাকা পরিবারের হার ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশে। অন্যদিকে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকা পরিবারের সংখ্যা ১৫ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।

এ বিষয়ে বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, ‘জেলার মানুষগুলো দিনমজুরির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আবার অর্থায়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও তাদের প্রবেশগম্যতা খুবই কম। অবকাঠামো উন্নয়ন এখনো পর্যাপ্ত নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ অঞ্চলের মানুষ আয়-বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও আঞ্চলিক অর্থনীতি বেগবান করতে না পারলে খুব সহজেই এ অঞ্চলের মানুষকে এ ধরনের সামাজিক দুর্বল অবস্থান থেকে বের করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে নদীভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বাড়াতে হবে সরকারি সুবিধায় দরিদ্রদের প্রবেশগম্যতাও।’

জেলাটির দারিদ্র্যতার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত নদীভাঙনের কারণে ভূমিহীন হচ্ছে মানুষ। শিল্পভিত্তিক তেমন কর্মসংস্থান না থাকার পাশাপাশি কৃষি ও চরাঞ্চলভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তেমন একটা গতি আসেনি। নদী ও মত্স্যসম্পদকেন্দ্রিক অর্থনীতি অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বন্যা সংকুচিত করছে আয়ের উৎসগুলোকে। মূলত এসব কারণেই দেশের শীর্ষ দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা হয়ে উঠেছে কুড়িগ্রাম।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের প্রগতিশীল চিন্তক ও কৃষক ফ্রন্টের সভাপতি আবদুল হাই রঞ্জু বলেন, ‘জেলাটির রৌমারী, রাজীবপুর, চিলমারী ও সদরের কিছু অংশের মানুষ প্রতিনিয়ত নদীভাঙনের শিকার হচ্ছেন। ফলে জমিহারা এসব মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ছে। আবার কুড়িগ্রাম জেলাটি কর্মহীন জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে শিল্প-কারখানাভিত্তিক তেমন কোনো কর্মসংস্থান নেই। কাজের জন্য অন্য জেলাগুলোয় গিয়েও খুব বেশি ভালো করতে পারছেন না স্থানীয়রা। আবার চরাঞ্চলে এখনো আধুনিক কৃষি সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানমুখী কার্যক্রম ও অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। এছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনায়ও জেলাটির জন্য সঠিকভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে।’

গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা ধরনের সহায়তা কার্যক্রম চালু রয়েছে। যদিও জেলাটির মানুষের কাছে সরকারি সেসব সহায়তাও সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দেশের ৩৫ শতাংশ পরিবারের প্রবেশাধিকার থাকলেও কুড়িগ্রামের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ভিজিএফ বা ভিজিডি সুবিধাভোগী মাত্র ১ শতাংশ করে। অন্যদিকে বিধবা কিংবা বয়স্কভাতা পাচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ পরিবার। ফলে দৈনন্দিন বা বড় ধরনের চাহিদা মেটাতে এখানকার বাসিন্দারা বাধ্য হচ্ছেন জমি বিক্রিতে। জেলাটির প্রায় ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ পরিবারই গত ১০ বছরে জমি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছে। জোরপূর্বক স্থানচ্যুত হয়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। আর নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ‘অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য কিংবা আর্থসামাজিক অবস্থানের যেসব তথ্য উঠে আসছে, সেগুলো অতিরঞ্জিত কিনা ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন। কেননা গত কয়েক বছরে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম ও গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিনিয়োগ ও অর্থায়ন করা হয়েছে। সামনের দিনে শুধু কুড়িগ্রাম জেলা নয়, গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।’