ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্ক-কর ছাড়সহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হলেও এর সুফল মিলছে না। এসব সুবিধা দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য- ওষুধ উৎপাদনে খরচ কমানো এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যাদের কথা ভেবে শুল্ক্ক ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তারা অর্থাৎ ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ওষুধের দাম। ওষুধের দাম বৃদ্ধির জাঁতাকলে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা অবশ্য দাবি করেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধের দাম কম। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম বাড়াতে হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছে, দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের তেমন কিছু করার নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জন করতে হলে অবশ্যই ওষুধের দাম কমাতে হবে। পাইকারি ওষুধের বড় বাজার মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন, রোগীদের বেশি প্রযোজন হয় এমন ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যান্সার প্রতিরোধক, ইনসুলিনসহ বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই হাজারের বেশি কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কাঁচামালে সম্পূর্ণ শুল্ক্কমুক্ত এবং কিছু কাঁচামালে শুল্ক্ক কমানো হয়েছে। কিছু কাঁচামালের দাম বেড়েছে সত্য, তবে বাজারে ওষুধের দাম বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে।
জানা যায়, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্ক ছাড়ের সুবিধা পাওয়া বেশিরভাগ ওষুধের গত পাঁচ বছরে দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। কোনো ওষুধের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে এর চেয়ে অনেক কম হারে। ইনসুলিন উৎপাদন উৎসাহিত করতে সব উপকরণে আমদানিতে শূন্য শুল্ক্ক করা হলেও এর দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। বর্তমানে অত্যাবশ্যকীয় ও জীবনরক্ষাকারী ১১৭টি ছাড়া বাকি সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো। ১৯৯৪ সাল থেকে এ নিয়ম চালু আছে। খ্যাতনামা ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মার ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, গত পাঁচ বছরে প্রায় প্রতিটি আইটেমের মূল্য ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে। আবারও কোনো কোনো ওষুধের মূল্য দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।
ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধের দাম কম। তা ছাড়া ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে আগের তুলনায় ওষুধ উৎপাদনে বেশি ব্যয় হচ্ছে। ওই ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ডলারের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। ডলারের বর্ধিত মূল্য দিয়েই কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ফলে ওষুধের মূল্য না বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রথম ওষুধনীতি প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান বাদ দিয়ে ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ক্যাসিনো তো সবাই খেলতে যায় না কিংবা জোর করেও কাউকে দিয়ে খেলানো হয় না। কিন্তু অসুস্থ হলে মানুষ ওষুধ সেবন না করে পারে না। সেই জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে, তারা অবশ্যই অপরাধী এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, গ্যাস্ট্রিক উপশমে ব্যবহূত ওমিপ্রাজল গ্রুপের একটি ওষুধ উৎপাদনে ৬০ পয়সা ব্যয় হয়। কিন্তু এটি ৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। সব ওষুধই উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। ওষুধের বাজার নিয়ে বছরের পর বছর ধরে নৈরাজ্য চলছে। সরকারকে বিষয়টি আমলে নিতে হবে। গুটিকয়েক ওষুধ কোম্পানি মালিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা যাবে না। ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালে আনার পাশাপাশি মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, শুল্ক্ক-কর ছাড়ের মূল উদ্দেশ্য জনগণ যাতে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে পারে। আমাদের দেশে ওষুধ শিল্পে বিভিন্ন সময়ে শুল্ক্ক ছাড়ের সুবিধাসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হলেও এর সুফল জনগণ তথা রোগীরা পাচ্ছে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুল্ক্ক ছাড়ের ফলে দেশে অনেক ওষুধ শিল্প দাঁড়িয়ে গেছে এবং বাজারও প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। তবে দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একটি মূল্য নির্ধারণ কমিটি গঠন করতে হবে। তারা পর্যালোচনা করে দাম ঠিক করে দেবে। কোম্পানিকে অবশ্যই মুনাফা দিতে হবে। তবে অতিরিক্ত মুনাফা নয়। অধ্যাপক ফারুক আরও বলেন, বর্তমান সরকার শুল্ক্ক ছাড়ের যেসব সুবিধা দিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। তবে রোগীরা যাতে এর সুফল পান তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যেসব অত্যাবশ্যকীয় ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ আছে সেগুলোর সংখ্যা বাড়িয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা আরও বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ওষুধের দামও ইতিমধ্যে কিছুটা কমানো হয়েছে। ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের তেমন কিছু করণীয় নেই জানিয়ে মহাপরিচালক আরও বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের শুধু মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আইন অনুযায়ী, যেসব কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদন করবে, তারা অন্যান্য ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করার সুযোগ পাবে। কোম্পানিগুলো ওষুধের মূল্য বাড়ালে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে কেবলমাত্র অবহিত করে থাকে। – সমকাল