উন্নত দেশগুলোর উচিত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা- প্রধানমন্ত্রী

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল প্রদানের প্রতিশ্রুতি পূরণে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৬) মূল অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের দায় দশমিক ৪৭ শতাংশের চেয়েও কম। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি।

মূল অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস ও আয়োজক দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জোট সিভিএফের চেয়ারপারসন হিসেবেও এ সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল অধিবেশনের ভাষণে চারটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন তিনি।

প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান কার্বন নিঃসরণকারীদের অবশ্যই উচ্চাভিলাষী কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত মাত্রা (এনডিসি) দাখিল করতে হবে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন ও প্রশমনে অর্ধেক অর্ধেক (৫০: ৫০) ভিত্তিতে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।

ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি শেখ হাসিনা তার তৃতীয় প্রস্তাবে বলেন, উন্নত দেশগুলোর উচিত স্বল্প খরচে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মাঝে ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজি ছড়িয়ে দেয়া। চতুর্থ ও সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব নেয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ক্ষতি ও ধ্বংস মোকাবেলা করতে হবে।

অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগে ১২ বিলিয়ন ডলারের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করেছে বলে জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিদেশী বিনিয়োগে ১২ বিলিয়ন ডলারের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ২০০৯ সালে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গত সাত বছরে আমরা জলবায়ুসংক্রান্ত ব্যয় দ্বিগুণ করেছি। বর্তমানে আমরা জাতীয় অ্যাডাপটেশন প্ল্যান তৈরি করছি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি উচ্চাভিলাষী এবং আপডেটেড এনডিসি পেশ করেছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম বড় ডমেস্টিক সোলার এনার্জি কর্মসূচিগুলোর একটি বাংলাদেশে রয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ু বিপদগ্রস্ত দেশ থেকে জলবায়ুসহিষ্ণু এবং সেখান থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশ ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গার কারণে জলবায়ুর ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলারও চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনা বলেন, সিভিএফ ও ভি-২০ চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮ দেশের স্বার্থের বিষয়গুলো তুলে ধরছে। আমরা ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার অফিস গ্লোবাল সেন্টার অব অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে আমাদের সেরা অনুশীলন এবং অভিযোজন জ্ঞান বিনিময় করছি। সিভিএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ একটি ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি চুক্তি করার চেষ্টা করছে।

২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়েছিল। সেই চুক্তির ফলে কার্বন নির্গমন ২০৫০ সালের মধ্যে কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশকে এখন কার্বন নির্গমন ব্যাপক হারে কমাতে হবে।

এর আগে কপ২৬ সম্মেলনের সাইডলাইনে ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ বিষয়ে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন সিভিএফ-কমনওয়েলথ উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড।

সিভিএফ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ক্রমাগত জলবায়ু বিপর্যয় বাড়ছে এবং সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে।

দায় কম হলেও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফের সদস্য ৪৮টি দেশ বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র ৫ শতাংশের জন্য দায়ী। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে।

অনুষ্ঠানে জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত জলবায়ুু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায়ই বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রথম শিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দুর্বলতা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ নিয়েছি।

সিভিএফ ও কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয়টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম সুপারিশে শেখ হাসিনা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিত অবস্থান নিতে বলেন। এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত অবস্থান জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে জলবায়ু অভিবাসীরা তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি, ঐতিহ্যগত পেশা হারাচ্ছে। এ মানুষগুলোর পুনর্বাসনে বৈশ্বিক দায়িত্ব রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সবার ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ প্রধান গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের উচ্চাভিলাষী ও আগ্রাসী এনডিসিএস ঘোষণা করাতে একটি চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। শেখ হাসিনা জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহনীয় খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজি হস্তান্তর করার কথা বলেন।