ঈদে ভোগান্তির আশঙ্কা, আগেই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

সড়ক ও নৌপথে ভোগান্তির আশঙ্কায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মরত মানুষজন তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের কয়েক দিন বাকি থাকতেই ছুটছে আপন ঠিকানায়।
এরকম প্রতি ঈদেই পাটুরিয়া ঘাটে বিড়ম্বনার শেষ নেই। বরাবরই ফেরি স্বল্পতা ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে নাকাল থাকে এই ঘাটটি। যার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রী বোঝাই যানবাহনগুলোকে পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকতে হয় পাটুরিয়া ঘাটে।

শুধু পাটুরিয়া ঘাটেই নয় আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে আরো বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয় ঈদে ঘরমুখো মানুষজনকে। সেখানে লক্কড়-ঝক্কড় মাত্র তিনটি ফেরি দিয়ে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার করায় ভোগান্তির মাত্রা অনেক বেশি। সব মিলিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা কাজিরহাট নৌরুটে এবার ঈদুল ফিতরের ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির মাত্রা বেশি আশঙ্কা করছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর অঞ্চলের মানুষ জন। এছাড়া ঢাকা আরিচা মহাসড়কের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে ঢিমেতালে। যার কারণে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন যাত্রী ও যানবাহন শ্রমিকরা।

দেখা গেছে, আসন্ন ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে গেল কয়েক দিন ধরেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার যাত্রী মানিকগঞ্জের আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাট হয়ে যে যার আপনালয় ফিরছেন। ইতিমধ্যে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বেড়েছে উভয় ঘাটে। ঈদের আগে দু’টি নৌরুটে ফেরি না বাড়ালে চরম ভোগান্তিতে পড়ার আশংকা করছেন এসব পথে চলাচলকারী যানবাহন শ্রমিক এবং যাত্রীরা।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭টি জেলার সহজ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে আরিচা-কাজিরহাট ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট। এ দুটি নৌরুটে যাত্রী এবং যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। কিন্তু ফেরি সার্ভিসের কোন উন্নতি না হওয়ায় উভয়ঘাটে দুর্ভোগ লেগেই থাকছে।

বিআইডব্লিউটিসি আরিচা আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা গেছে, আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ২টি কে-টাইপ (ছোট) ও ১টি ডাম্ব মোট ৩টি ফেরি রয়েছে। এসব ফেরি লোড-আনলোডের জন্য আরিচায় ২টি এবং কাজিরহাটে ২টি ঘাট রয়েছে। এ নৌরুটে যানবাহন এবং যাত্রী বাড়লেও ফেরি বাড়ানো হয়নি। স্বল্প সংখ্যক ফেরি দিয়ে এ নৌরুটে ফেরি সার্ভিস ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ঈদকে সামনে রেখে নৌরুটে কমপক্ষে নতুন চারটি ফেরি দরকার বলে জানিয়েছেন ফেরি কর্তৃপক্ষ।

এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। এই নৌরুটে ২৩টি ফেরি ছিল। এর মধ্যে একটি ফেরি চলাচলের একেবারে অনুপযোগী। এছাড়া গত ২৭শে অক্টোবরে রো রো ফেরি শাহ আলী এবং গত প্রায় এক মাস ধরে রো রো ফেরি গোলাম মওলা এবং ছোট ফেরি শাপলা শালুককে মেরামতের জন্য নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। মেরামত শেষে ঈদের আগে ফেরিগুলো পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌবহরে যুক্ত হবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে ফেরি কর্তৃপক্ষের।

বর্তমানে এ নৌরুটে ১৯টি ফেরির মধ্যে ১১টি রো রো (বড়), ৫টি ইউটিলিটি, ২টি ডাম্ব এবং ১টি ছোট ফেরি রয়েছে। এসব ফেরির অধিকাংশই দীর্ঘ দিনের পুরাতন ও লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা হওয়ায় প্রতি দিনই দু’/একটি ফেরি স্থানীয় পাটুরিয়া ভাসমান কারখানায় মেরামতে থাকছে। শনিবার সকাল পর্যন্ত পাটুরিয়া ভাসমান কারখানায় ইউটিলিটি ফেরি রজনী গন্ধা ও বনলতা মেরমতে থাকতে দেখা গেছে। এতে ১৯টি ফেরির মধ্যে ১৭টি ফেরি চলাচল করছে।

এদিকে এসব ফেরি লোড-আনলোডের জন্য পাটুরিয়াতে ৫টি ঘাটের মধ্যে ৪টি ঘাট সচল রয়েছে। পন্টুন সমস্যার কারণে ২নং ঘাটটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দৌলতদিয়ায় ৭টি ঘাটের মধ্যে সচল রয়েছে ৪টি । বাকি তিনটি ঘাটের ২টি ঘাট গত ২০১৯ সালে নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া ২নং ঘাটটি সচল থাকলেও বেশি খাড়া হওয়ায় ওখানে ফেরি ভিড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ফেরি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে ওই ঘাট দিয়ে যানবাহন লোড-আনলোড বন্ধ রয়েছে।

তাছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ৫টি করে ঘাট থাকলে ব্যবহার হচ্ছে ৪টি করে। এ পরিস্থিতি অব্যহত থাকলে আসন্ন ঈদুল ফিতরে বাড়তি যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘাট কর্তৃপক্ষের সূত্রমতে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে তিন হাজার গাড়ি পারাপার হয়ে থাকে। তবে ঈদের আগে যানবাহনের চাপ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

পাটুরিয়া ঘাটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীদের সাথে কথা হলে তারা জানান দুর্ভোগের কথা।
খুলনার যাত্রী আব্বাস মিয়া জানান, ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করি। ঈদের আগে রাস্তায় যানজট এবং বাড়তি ভাড়াসহ নানা ধরনের বিড়ম্বনার কারণে আগেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। ঈদের আগে রাস্তায় নানা ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা এড়ানোর জন্যই তিনি এ কাজ করছেন।

কুষ্টিয়াগামী যাত্রী আব্দুল হামিদ বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি। ঈদের আগে বাসের টিকিট সংকট, বাড়তি ভাড়া আদায়, রাস্তায় যানজটে আটকে পড়াসহ নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ ভোগান্তি এড়াতেই পরিবার নিয়ে আগে-ভাগেই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি।

ফরিদপুরে যাত্রী আকমল হোসেন বলেন, প্রতি ঈদেই পাটুরিয়া ঘাটে আমাদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সাত-আট ঘণ্টা পর্যন্ত ফেরির জন্য পড়ে থাকতে হয়। তাই এবার আগেই স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি।
মাদারীপুরের যাত্রী ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ বড়ই অভাগা। নদী পার হতে গিয়ে সারা বছরই আমরা দুর্ভোগে থাকি। আর ঈদের সময় তো দুর্ভোগের সীমা থাকে না তাই আগেই চলে যাচ্ছি বাড়িতে। এদের মত শত শত মানুষ ঈদে ভোগান্তির কথা মাথায় নিয়ে আগেই যাচ্ছেন যে যার আপন ঠিকানায়।

বিআইডব্লিউটিসির সহকারী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান জানান, যে সব ফেরির সামান্য ত্রুটি দেখা দেয় সে সব ফেরি পাটুরিয়া ভাসমান কারখানায় এনে মরামত করা হয়। রজনীগন্ধা ও বনলতা নামের দু’টি ইউটিলিটি ফেরি পাটুরিয়া ভাসমান কারখানায় মেরামতে রয়েছে। এছাড়া বড় ধরনের কাজের প্রয়োজন হলে নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড পাঠানো হয়।

ঘাট রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ঘাটের কোন সমস্যা নেই। ফেরি লোড-আনলোডের জন্য পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়ায় ৫টি করে ঘাট রয়েছে। এর মধ্যে পন্টুন সমস্যার কারণে পাটুরিয়ায় ১টি ঘাট বন্ধ এবং দৌলতদিয়ায় ৫টি ঘাটই সচল রয়েছে কিন্তু ২নং ঘাটটি সচল থাকা সত্তেও কি কারণে ওই ঘাটে ফেরি ভিড়ানো হচ্ছে না তা আমার জানা নেই। তাই ফেরি লোড-আনলোডের জন্য দৌলতদিয়ায় চারটি ঘাট ব্যবহার হচ্ছে। এদিকে আরিচায় ২টি এবং কাজিরহাটে ২টিসহ মোট চারটি ঘাটই সচল রয়েছে।আশা করি ঈদের সময় ঘাট নিয়ে কোন সমস্যা হবে না বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌপরিবহন কোরপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম শাহ মোঃ খালিদ নেওয়াজ বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ১৯টি ফেরির মধ্যে ১৭টি ফেরি চলাচল করছে।দু’টি ফেরি পাটুরিয়া ভারসমান কারখানায় সাময়িক মেরামতে রয়েছে। ঈদের আগে আরো দু’টি ইউটিলিটি ফেরি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সাথে আরো ২টি রো-রো ফরি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেরামতে থাকা ফেরিগুলো এ নৌবহরে যুক্ত হলে আসন্ন ঈদুল ফিতরে কোন সমস্যা হবে না বলে তিনি জানান।

এদিকে শনিবার সকাল থেকে পাটুরিয়া ঘাটে বড় যানবাহনের চাইতে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি অর্থাৎ প্রাইভেট কার মাইক্রোবাসের চাপ বেশি। পাটুরিয়া ৫ নং ফেরি ঘাটে ছোট গাড়ি লম্বা লাইন দেখা গেছে।