আন্তর্জাতিক সনদ নেই ৩৭ ভাগ পোশাক কারখানার

তৈরি পোশাক খাতের ছোট কারখানাগুলোর মধ্যে ৩৭ শতাংশেরই নেই আন্তর্জাতিক সনদ। সে তুলনায় বড় কারখানাগুলো বেশ এগিয়ে রয়েছে। গতকাল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে ‘জাতিসংঘের নীতিকাঠামোর আলোকে পোশাক খাতে শ্রম ও কর্মপরিবেশের উন্নয়ন’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।

ক্রিশ্চিয়ান এইড ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ আয়োজনে অংশ নেন সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক, শ্রম সচিব মো. এহছানে এলাহী, তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আলোচনায় বক্তারা বলেন, শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে কারখানার কর্মপরিবেশ ভালো করা সম্ভব।

শ্রমিক আইনের বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পরামর্শ উঠে আসে আলোচনা সভায়।

মূল প্রবন্ধে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ৬০৩টি পোশাক কারখানায় সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ান এইড ও সিপিডির যৌথভাবে পরিচালিত একটি জরিপের ফল উপস্থাপন করা হয়। প্রধানত এসব কারখানার শ্রমিক মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

মূল প্রবন্ধে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে মানবাধিকার নীতি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। সুশাসনের চর্চা হচ্ছে মাত্র ৩৮ শতাংশ কারখানায়। কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতি হয়েছে মাত্র ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ কারখানায়। অন্যদিকে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ২০ দশমিক ২ শতাংশ মালিক কাজ করছেন। শ্রমিকদের ঝুঁকি মোকাবেলায় উদ্যোগ নিয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ কারখানা। পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ সমস্যা নজরদারিতে রাখে এবং ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ কারখানা মালিক সুশাসনের প্রতিকার নিয়ে কাজ করে বলে জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ভয়াবহ ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কর্মপরিবেশ বিশেষত শ্রমিকদের প্রতি কতটা সদয় মালিকরা, এটা জানতে আমরা এ জরিপ পরিচালনা করি। গত প্রায় এক দশকে দেশে পোশাক খাত এগিয়ে গেলেও এখনো কারখানাগুলোর ভেতরে শ্রমিকদের ন্যায্যতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ততটা হয়নি, বিশেষ করে ছোট কারখানাগুলোয়।

মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমাদের দেশে এখনো পোশাক খাত বা অন্য খাতের শিল্প মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক ভ্রাতৃপ্রতিম হয়নি। শ্রমিকরা যেমন তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার থাকেন, তেমনি মালিক পক্ষও চাইবে অধিক উৎপাদন। তাই উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে দুই পক্ষই লাভবান হতে পারে, সে বিষয়টি খুঁজে বের করতে হবে। শ্রমিকরা সুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে না পারলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উৎপাদন সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অথচ উৎপাদন বাড়াতে পারলে মালিকপক্ষের লাভই বেশি। তাই মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাই কর্মপরিবেশ, ঝুঁকি, বেতনবৈষম্য এবং সব ধরনের হয়রানিসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনায় শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মো. ইহসান-ই-ইলাহী বলেন, গত দশ বছরে পোশাক মালিকরা অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছেন। মালিকরা এখন নৈতিক দায়িত্ববোধের অবস্থানে অনেক সচেতন হয়েছেন। তবে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে হচ্ছে না। শ্রম অধিকার পূর্ণ করতে না পারলে ২০২৪ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে আমরা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হব। এ কারণে এখন থেকেই শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে বড় পরিসরে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বর্তমানে এ শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ক্রয়াদেশে দরপতন। এ দরপতনের কারণে আমরা শ্রমিকদের বেতন ও বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির বিষয়টির নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের ঝুঁকি কমানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য আমরা সরকার, মালিক ও শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক উন্নতিও হয়েছে। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশের পোশাক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের কথা উন্নত বিশ্বে পৌঁছে দিতে প্রচারণা চালিয়েছি। ক্রেতারা পোশাকের দাম কিছুটা বাড়ালে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা অনেকটাই সহজ হয় বলে মনে করেন তিনি।

আলোচনায় বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, বর্তমানে দেশের পোশাক খাতে আগের সেই পরিবেশ নেই। এখন কর্ম ও ঝুঁকি পরিবেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পোশাকের দরপতন আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। ২০১৩ সালে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের সঙ্গে আমাদের তিনটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের মানবাধিকার, ঝুঁকি কমানো এবং পোশাকের দরবৃদ্ধির কথা ছিল। শ্রমিকদের উন্নয়নে যা করা দরকার, তার অনেকটাই আমরা করেছি। কিন্তু বায়াররা তাদের কথা রাখেনি। তারা দরপতন অব্যাহত রেখেছে।